‘দেওয়া-নেওয়া’র দুর্নীতির কেচ্ছায় তিন রত্ন
বহুদিন আগে 'দেওয়া-নেওয়া' নামে একটি বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। উত্তম কুমার ও তনুজা অভিনীত ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে। এটা রোমান্টিক কমেডি ছবি হলেও এতবছর পর ছবির নামটা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে এতটা বাস্তব হয়ে উঠবে তা কি কখনো কেউ ভেবেছিলেন।
সম্প্রতি সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের দুর্নীতির কাহিনী যেভাবে বের হচ্ছে তাতে অনেকের চোখ কপালে উঠেছে। আলোচনা-সমালোচনা চলছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। অনেকেই বলছেন যে, আমরা তো এতদিন রাজনীতিকদের দুর্নীতির কথা শুনে আসছি, এখন দেখছি আমলারা দুর্নীতিতে রাজনীতিকদের ছাপিয়ে শীর্ষে পৌঁছে গেছে।
আসলে তা নয়। সব সময় রাজনীতিক ও আমলাদের যৌথ প্রযোজনায় দুর্নীতি চলে আসছে 'দেওয়া-নেওয়া' পদ্ধতিতে। ওই যে দেবেন আর নেবেন। অর্থাৎ আমলা সাহেব কাজটা করে দিলে রাজনীতিক ২০ টাকা নেবেন, আমলা সাহেবও ৫ টাকা নেওয়ার সুযোগ পাবেন। রাজনীতিকরা আমলাদের ওপর বেশি ভর করলে আমলারা আরো বেশি সুযোগ গ্রহণ করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তাই হয়েছে বর্তমানে। ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা দুর্নীতির এমন এক বাধা-বন্ধনহীন পরিবেশ তৈরি করেছে যার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছে আমলারা। কোনো মন্ত্রী সৎ হলে কোনো সচিবের পক্ষে দুর্নীতি করা খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
তাই এটা বলা যায় যে, দেওয়া-নেওয়া ফর্মুলায় আমলা ও রাজনীতিক উভয়ই উভয়কে ব্যবহার করে দুর্নীতি করে চলেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সকল ধরনের অনৈতিক কাজে আমলাদের এতটা যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করেছে যে, তারা এর সুযোগ গ্রহণ করেছে পুরোপুরিভাবে। যেমন, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনের পর ছোটখাট অনেক পুলিশ অফিসারকে গৌরবের সঙ্গে বলতে শুনেছি যে, এ সরকারকে তো আমরাই ক্ষমতায় এনেছি। ভাবখানা এমন, আমরা এখন যা খুশি তাই করতে পারি। হয়েছেও তাই। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া তখন রাতের নির্বাচনের মূল পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী ছিলেন। ফলে সরকার তাদেরকে 'ব্ল্যাংক চেক' দিয়ে দিয়েছিল। আর সেই সুযোগ তারা কাজে লাগিয়েছে পুরোপুরি।
এখন বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এই সব আমলা চরম অনৈতিক কাজগুলো করে আজ অবসরে গিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে ধিকৃত হলেও পৃষ্ঠপোষক ও নির্দেশদাতারা ধোয়া তুলশী পাতা থেকে যাচ্ছে। তবে যে সব মিডিয়া গদি মিডিয়া হিসাবে পরিচিত তারাও যখন ওই সব আমলার বিরুদ্ধে লিখছে, তখন সরকারের অভিসন্ধি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, হয়তো সরকার দুদকের মাধ্যমে এদের দুর্নীতিকে জায়েজ করতে অর্থাৎ তাদের আয়র উৎস বৈধ করার জন্য এটা করেছে। এমনও হতে পারে, তাদের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের মধ্যে আরো কোনো ক্ষমতাবানদের হিস্যা আছে। তাই এটা বৈধ করা দরকার। কিংবা মার্কিনীদের খুশি করতে এদের বলির পাঁঠা করা হচ্ছে।
এসব কুশীলব শীর্ষপদে থাকাকালে যখন আওয়মী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সব ধরনের নীতিহীন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তখন কিন্তু ঘুণাক্ষরে ভাবেননি যে, তাদের একদিন অবসরে যেতে হবে। কিংবা পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে এবং তারা বিপদেও পড়তে পারেন। তারা সহজভাবে বুঝেছিলেন, যে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এত কিছু করেছেন সে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তাদের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।
তবে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এমনই। খুবই নিষ্ঠুরতম শাসন এটা। পদে থাকাকালে দাম আছে, না থাকলে আঁস্তাকুড়ে। খুব পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলা হয়। অনেক দেশেই এ রকম ঘটনা ঘটেছে। কথিত আছে, জেনারেল সুহার্তো ইন্দোনেশিয়ায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সমাজের কিছু খারপ লোক ও রাজনৈতিক বিরোধিদের নিশ্চিহ্ন করতে ষণ্ডাদের কাজে লাগিয়েছিলেন। পরে কাজ শেষ হলে ষণ্ডাদের নিশ্চিহ্ন করে দেন। বাংলাদেশেও সে ধরনের কিছু ঘটছে কিনা তাও ভেবে দেখার বিষয়।
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে ঘুষ হিসাবে ওদের দুর্নীতি করার অবাধ সুযোগ দিয়েছিল। একনায়করা এভাবেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরোপুরি দুর্নীতিগ্রস্ত করে টিকে থাকে। বিচারক, সামরিক-বেসামরিক আমালাসহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষকে অন্যায় সুবিধা দিয়ে তারা ক্ষমতা সংহত করে। বিশেষ করে, সেনাবাহিনী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে কাজ করে। যেটা জেনারেল আজিজ করেছিলেন।
যে সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কেবল মাত্র টাকা রাখার পদ্ধতিগত ভুলের জন্য জেল দিতে পারে, যে সরকার তাদের ভাষায় অপরাধীদের মাটির তল থেকে ধরে আনে সে সরকারের গোয়েন্দারা বেনজির-আছাদুজ্জামানদের দুর্নীতির খবর জানতো না তা কি কেউ বিশ্বাস করবে?
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাধারণত এমন লোকদের দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় শুরু করে, যাদেরকে সরকার-বিরোধী বলে কমিশন মনে করে। ড. ইউনূস 'অপরাধী' কিন্তু এস আলম গ্রুপ ধোয়া তুলশী পাতা। এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। তাছাড়া মিডিয়ার মাধ্যমে বেনজিরদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে না আসলে দুদক হয়তো চোখ ফিরিয়েই রাখতো। মূলত, বিনাভোটের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিতে বা রাখতে জেনারল আজিজ, বেনজির, আছাদুজ্জামানের মতো যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তাদের বিরুদ্ধে দুদক এ্যাকশনে যাবে এবং এই সরকারের আমলে, তা কখনো ভাবা যায়নি। কিন্তু কোথায় যেন একটা গন্ডগোল হয়েছে।
কোথায়? সেটিই প্রশ্ন।