খালেদা জিয়াকে নীরবে হত্যা
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গেল কয়েক বছর ধরে কারাগারের প্রকোষ্ঠে বন্দি। ৭৮ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। কিন্তু তিনি নিয়মিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। এর চেয়ে ভালো চিকিৎসা সেবা যে তার প্রাপ্য এটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই এটি বিশ্বাস করেন যে, যেসব অভিযোগে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও সেনা-সমর্থিত অনির্বাচিত ফখরুদ্দিন আহমেদের আমলে একই ধরনের মামলা হয়েছিল।
মূলত, সামরিক আইনের অধীনে এসব অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। তবে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসলে তার বিরুদ্ধের এসব মামলা একে একে তুলে নেওয়া হয়। এটি করতে গিয়ে কিছুটা ব্যতিক্রমও করেছে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা খুব সহজে পার পেয়ে গেলেও বিরোধীদের ক্লিন চিট দেওয়া হয়নি।
খালেদা জিয়ার স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের জন্য বীরত্বের সঙ্গে লড়েছিলেন। দেশের প্রতি তার অবদান এখানেই শেষ নয়। সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করেছিলেন।
পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগহ অন্য সব দলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা বৈধতা ফিরিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের প্রতি শেখ হাসিনার শুধু যে এখানেই ঋণী তা কিন্তু নয়। ফখরুদ্দিন আহমেদের আধা-সামরিক শাসনের সময় ষড়যন্ত্রকারীরা খালেদা জিয়াকে নির্বাসনে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনেও খালেদা জিয়া অংশ নেন, যেখানে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছিল। এর কয়েক বছরের মধ্যেই খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফখরুদ্দিনের ওই শাসনামলে খালেদা জিয়া নির্বাসনে যেতে রাজি হলে দেশে সামরিক শাসন আরও প্রকাশ্য এবং পাকাপোক্ত হতো। সে সময় খালেদা জিয়ার দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্তই জাতিকে দীর্ঘ মেয়াদে সামরিক শাসনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
একইভাবে তখনকার নির্বাচনেও যদি খালেদা জিয়া অংশ না নিতেন, তবে দেশের রাজনীতিতে নতুন বাকবদল হতো। বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিন ছিল। তবে নির্বাচনের অংশ না নেওয়ার জন্য সব কারণ থাকার পরেও খালেদা জিয়া ভোটে গিয়েছিলেন।
তখন বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কারাগারে এবং পলাতক থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন দলটির শীর্ষ অনেক নেতা। এমনকি, খালেদা জিয়ার ছেলে পর্যন্ত দেশের বাইরে নির্বাসিত ছিলেন। এই তালিকা বলে শেষ করা যাবে না।
বরাবরই খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে গিয়ে দেশের গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই জেনেও তিনি ভোটে গিয়েছেন। তখন তিনি হয়তো এটাও জেনে গিয়েছিলেন যে, ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর চেষ্টায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় নির্দিষ্ট কাউকে আনা হচ্ছে।
খালেদা কখনই দেশের জনগণকে ছেড়ে যাননি। প্রকৃত রাজনীতিবিদের মতোই তার কাছে দেশের জনগণই প্রথম। সে জন্যই তাকে এখন মূল্য দিতে হচ্ছে।
খালেদা জিয়াকে বিদেশে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তার সঙ্গে অন্য সব মামুলি অপরাধীর মতো আচরণ করা হচ্ছে। তাকে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠী সেই নারীকে নীরবে হত্যা করছে, যিনি কি-না দেশের গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা।
খালেদা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের জাতির প্রধান মূল্যবোধের জন্য একটি শব্দ। তবে গুরুতর অসুস্থ খালেদাকে অন্য যে কারো চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় মূল্যবোধের একটি প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছেন খালেদা। তবে গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াও অন্য যে কারও চেয়ে শক্তিশালী।
হাসপাতালে শয্যাশায়ী হওয়ার পরেও তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন; অনেকটা পাথরের মতো লম্বা এবং সুবিন্যস্ত হয়ে। যা প্রতিবেশী যেকোনো দেশের দুঃসাহসিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিংবা কোনো ফ্যাসিবাদী শাসকের বাকি জীবনের ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নকে আটকাতে খুব ভালোভাবেই সক্ষম।
সামনের দিনে জাতীয় জীবনে সংগ্রামের নাম হয়ে উঠবে খালেদা জিয়া। এই সংগ্রাম হবে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের জন্য; যেখানে সাধারণ বাংলাদেশিরা সমতা, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের পাবে।
খালেদা জিয়াকে আজ যারা নীরব হত্যাকাণ্ডের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাদের একদিন আইনের আওতায় আনা হবেই। ইতিহাস বলছে, সেই দিন বেশি দূরে নয়।