ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর ক্ষমতাবানদের মুখোমুখি অরুন্ধতী
১৪ বছর আগে করা একটি মন্তব্যের জেরে চলতি মাসে ভারতের বুকারজয়ী লেখক অরুন্ধতী রায় ও কাশ্মীরের আইনের শিক্ষক শেখ শওকত হুসেনের বিরুদ্ধে দেশটির কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচারের অনুমতি দিয়েছেন দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। দিল্লির রাজ্য সরকারে রয়েছে বিরোধী আম আদমি পার্টি, যদিও সেখানকার পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। নরেন্দ্র মোদি সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন। অনেকে ভেবেছিলেন মোদি এবার কিছুটা নমনীয় হবে, বদলাবেন। অনেকে ভেবেছিলেন অরুন্ধতী রায়ের বিচারকার্যের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসবে; তবে এই ভাবনার মানুষেরা হতাশই হচ্ছেন।
আজাদী (স্বাধীনতা) নামে একটি সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য শওকত হুসেন এবং অরুন্ধতী রায়কে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। তখন মূলত কাশ্মীরে ভারতীয় শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেখানে স্বাধীনতার পক্ষে বিক্ষোভ হচ্ছিল। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কয়েকজন নিহতের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। শওকত হুসেন একজন কাশ্মীরি শিক্ষক, লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী। আর অরুন্ধতী রায় ভারতের সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখকদের একজন, সারা বিশ্বেই তিনি পরিচিতি পেয়েছেন।
অরুন্ধতীর শৈশব অনুপ্রাণিত পারিবারিক উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-এর জন্য তিনি ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পান। যে কারণে অল্প বয়সেই তারকা লেখক বনে যান। এটি ছিল সেই বছর যখন ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছিল, একই বছরে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত বুকারজয়ী সালমান রুশদী নতুন ভারতীয় সাহিত্যের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। অরুন্ধতী রায় তখনও তরুণ, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের উদীয়মান কণ্ঠোস্বর হয়ে উঠেছিলেন। যা উপমহাদেশের অনেক না বলা গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। অরুন্ধতী রায় অনুসরণ এবং অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিলেন। মীরা নায়ারের ২০০১ সালের চলচ্চিত্র ‘মনসুন ওয়েডিং’-এ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সৃজনশীল লেখালেখি করতে চান বলে তার এক চাচাকে অভিপ্রায় জানান। তখন ওই চাচা বলেছিলেন: ‘আজকাল লেখালেখিতে প্রচুর অর্থ।’ অর্থাৎ, বুকার জিতে অরুন্ধতী রাতারাতি মিলিয়নার হয়ে গিয়েছিলেন।
তবে সেই ক্ষমতাবান ও সুবিধাপ্রাপ্ত চাচাদের অনেকেই আজ খুশি নন। অরুন্ধতী রায় ২০১০ সালের ওই সম্মেলনে বলেছিলেন, কাশ্মীর কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। এর এতদিন পর যখন সাক্সেনা ঘোষণা করলেন অরুন্ধতীকে ভারতের কঠোর বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের (ইউএপিএ) অধীনে বিচার করা যেতে পারে, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রতিবাদ এসেছে; বুদ্ধিজীবী এবং লেখকদের সংগঠনগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তবে ভারতে এর প্রতিক্রিয়া ছিল কম। তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্রের মতো রাজনীতিবিদরা এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যরা সরকারের প্রশংসা করেছেন এবং যারা অরুন্ধতীর পক্ষে কথা বলেছেন তাদের প্রতি আগ্রাসী হয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো- অরুন্ধতী রায় ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, দেশদ্রোহী এবং তার সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে। যে কারণে তাকে আইনের মুখোমুখি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
ইউএপিএ একটি কালো আইন। এতে জামিন পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বিচার শুরু হওয়ার আগেই অভিযুক্তকে হেফাজতে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এই আইনে। এক্ষেত্রে বিচারকাজ শুরু হতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগতে পারে, যেমনটা নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে অন্য রাজনীতিবিদদের বেলায় দেখা গেছে।
অরুন্ধতী রায়ের ক্ষেত্রে এই আইনের ব্যবহার ছিল বিভ্রান্তিকর। আইনজীবীরা পদ্ধতিগত ফাঁকফোকরের কথা উল্লেখ করছেন। মামলার তদন্তকাজ শেষে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যেটাকে বলা হয় চার্জশিট। এটি দাখিলের পরই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। অরুন্ধতী রায়ের এই মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে কি-না সেটি এখনও ধোঁয়াশা। কর্তৃপক্ষ কেন ইউএপিএ’র ব্যবহার করতে চায় সেটির ব্যাখ্যা চেয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। একইসঙ্গে সাক্সেনার আদেশেরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। গত ১৪ জুন তিনি এই মামলাটি পরিচালনার আদেশ দিয়েছিলেন। ইউএপিএ’র অধীনে বিচার শুরু হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। ঘটনার প্রমাণাদি স্বাধীনভাবে পর্যালোচনা করার পরেই কর্তৃপক্ষ কেবল এই ধরনের অনুমতি দিতে পারে। তবে অরুন্ধতী রায়ের ক্ষেত্রে এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কি-না সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
শত বিড়ম্বনা পোহানোর পরেও অরুন্ধতী যদি জনগণের সহানুভূতি না পান তবে এই শতাব্দির শুরুতে ভারত কতটা বদলে গেছে এতে সেটিই প্রতিফলিত হয়। দেশটির উচ্চবিত্তরা এখন তাদের পুরোনো দিনের দুর্দশার চিত্র মুছে ফেলতে চান। এরাই আবার ভারতের পাদ-প্রদীপে জায়গা করে নিচ্ছেন। আর যারা ভিন্নমতাবলম্বী এবং লেখালেখির মাধ্যমে নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা খলনায়ক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ যেসব ইস্যুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ক্ষমতাবানদের ঐকমত্য রয়েছে সেখানে কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন অরুন্ধতী রায়।
এবার কাশ্মীর নিয়ে অরুন্ধুতীর দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করা যাক। এই বিতর্কিত অঞ্চলটি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান কমপক্ষে তিনবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এখানে পাকিস্তান-সমর্থিত বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা চেয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানে কয়েক হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলে আসছে, সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অপব্যবহার হচ্ছে। অরুন্ধতী রায় কাশ্মীরিদের কণ্ঠস্বর অনুধাবন করেছেন। তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রকে চ্যালেঞ্জ করে আসছেন। কাশ্মীর নিয়ে সরকার যে চিত্র উপস্থাপনের চেষ্টা করে অরুন্ধতী সেটিকেই বারবার চ্যালেঞ্জ করেছেন। তার উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ কাশ্মীর সংকটকেই তুলে ধরেছে। যদিও ক্ষমতাসীনরা তার এই সমালোচনা শুনতে চান না।
অরুন্ধতী যেভাবে বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষিজমির সেচ দেওয়ার সমালোচনা করেন সেটি খুব বেশি ভারতীয় পছন্দ করেন না। বাঁধ নির্মাণ ছিল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর স্বপ্ন। তিনি আধুনিক আধুনিক ভারতের দুর্গ হিসেবে এটিকে উল্লেখ করেছিলেন। বাঁধ কৃষকদের সেচ দিতে সহায়তা করার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনেও কাজে লাগে। তাই অনেক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞই অরুন্ধুতীর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু অরুন্ধতী আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন এটি করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ কীভাবে হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। ক্ষমতাসীনদের দ্বারা বাধ্যতামূলকভাবে নিজ ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
‘অস্পৃশ্য’ দলিতদের ব্যাপারে গান্ধীর মতামতেরও সমালোচনা করেছেন অরুন্ধতী। তিনি তাদের বৈষম্যের পৃষ্ঠপোষক বলে অভিহিত করেছেন। একইসঙ্গে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা এবং সমরাস্ত্রের সোচ্চার সমালোচক ছিলেন। তার এই অবস্থান ভারতের রক্ষণশীল এবং উদারপন্থী মতামতের বিপরীত। ভারতের শান্তিবাদীরা গান্ধীর প্রশংসা করে থাকেন; ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা গান্ধীকে ঘৃণা করলেও আবার বোমাকে ভালোবাসে। এটি সত্য যে অরুন্ধতী বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তাকে লেখার জন্য জায়গা দেয়, নাড়া দেয় এবং আলোচনার তৈরি করে। যেখানে ভারতের ক্ষমতাবানরা শুধু প্রশংসেই শুনতে চায়; সেখানে অরুন্ধতী তার উল্টোটাই করে চলেছেন, তুলে ধরছেন পচনের কথা।
এখন দেখার বিষয় আদতে তার বিচার হয় কি-না। আদালত মনে করতে পারে তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই; আবার অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে। অরুন্ধতীর আইনজীবীরা তাদের পদ্ধতিগত আপত্তিতে সফল হতে পারেন। আবার সরকার এক্ষেত্রেও অস্পষ্টতা বজায় রাখতে পারে। এভাবে তারা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে।
তবে একটি বিষয় নিশ্চিত- মোদি বদলে গেছেন বা বদলে যাবেন এমন ধারণাটা ভুল। অন্তত অরুন্ধতী রায়ের মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাদৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সরকার যেমনটি করলো এক্ষেত্রে এমনটি মনে করা বোকামি ছাড়া কিছু না। ভারতে সমালোচকদের ওপর খড়গ ঝুলছে। অরুন্ধতী রায় আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন- কেন অসির চেয়ে মসি বড়।
লেখাটি দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত; সলিল ত্রিপাঠী নিউইয়র্কভিত্তিক একজন লেখক এবং পেন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে রয়েছেন। তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘দ্য গুজরাটিস’ চলতি বছর প্রকাশিত হবে।