মতিউর, বেনজীর, আজিজ প্রমুখের বিরুদ্ধে ঘৃণা, ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশকারীদের "বোঝার ঘাটতি" আছে!
সাম্প্রতিককালে কিছু মানুষের কাণ্ডকীর্তি পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। সেই সব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুকসহ দেশের প্রায় ৪ লাখ টি স্টলে প্রতিদিন কয়েক কোটি মানুষ চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন। প্রায় সবার মধ্যে একটা সাধারণ প্রশ্ন—কেমনে এতো টাকা আর সম্পদ বানাইলো?
আমজনতার আলোচনায় আরো একটি বিষয় কমন সেটা হলো—নানানভাবে এদের পরিবারের সদস্যদের চরিত্র হরণ করা। যেহেতু কারো কাছেই সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই তাই যে যার মতো করে ধারণার ভিত্তিতে তথ্যকে টুইস্ট করছে কিংবা তথ্যের ডালপালা তৈরি করছে।
তবে কয়েক বছরের মধ্যে সম্পদ বানানো সংক্রান্ত যে কমন প্রশ্নটি মানুষ করছে তার পদ্ধতিগত উত্তর খোঁজার মধ্যেই এরা কী করে রাতারাতি এতো সম্পদের মালিক হলো সেই জবাবটি লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেদিকে না এগিয়ে বেশিরভাগ মানুষ ব্যক্তির কাণ্ডকীর্তিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কিংবা আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠছে। ফলে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার ভাষায় 'ভাইরাল' হলেও এইরকম একাধিক ঘটনা কেন ঘটছে কিংবা এর সমাধানই বা কী সে সব আলোচনায় আসছে কম।
আলোচিত মতিউর রহমান, বেনজীর আহমেদ, আজিজ আহমেদ প্রমুখদের একটি সাধারণ পরিচয় আছে। পেশাগতভাবে তারা তিনজনই চাকরিজীবী। কাকতালীয়ভাবে তারাসহ এই সময়ে আরো যাদের সম্পদ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে তারা প্রায় সকলেই সরকারি চাকরিজীবী। এবং সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় তারা বেতনের বাইরে এই বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছেন।
এর সহজ মানে হলো—সরকারি চাকরিতে এমন কোনো সিস্টেম বা ব্যবস্থা রয়েছে যা ব্যবহার করে বৈধ বেতনের অতিরিক্ত অবৈধ আয়ের সুযোগ আছে। আলোচ্য ব্যক্তিরা সেই সিস্টেমের সুযোগ নিয়েছেন।
তারা যা করেছেন আইনের দৃষ্টিতে সেটা অপরাধ কি অপরাধ নয়, এর সাজা কী হওয়া উচিত আমি সেই আলোচনায় যাব না। কারণ আলোচ্য ব্যক্তিরা যা করেছেন, সিস্টেম সংশোধন না হলে এই কাজ ভবিষ্যতে মতিউর, বেনজীর, আজিজের পরিবর্তে অন্য কেউ করবে। কারণ মানুষ রিপু দ্বারা তাড়িত হয়। এই কারণেই বাংলা ভাষায় ষড়রিপু শব্দটি আছে। যার মধ্যে আছে—কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। মতিউর, বেনজীর ও আজিজ মূলত লোভ রিপুর বশবর্তী হয়ে সিস্টেমের ফাঁক-ফোকরকে ব্যবহার করে এই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রশ্ন হলো, রিপু কি শুধু এই তিনজনের মধ্যেই আছে? তা কিন্তু নয়।
সবার মধ্যেই রিপু লুকায়িত থাকে, সুযোগ বুঝে মাথাচাড়া দিতে চায়। কেউ কেউ চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে রিপু দমন করেন। সেই ধরনের চারিত্রিক দৃঢ়তা সবার মধ্যে আশা করা যায় না বলেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় একটি উপযুক্ত সিস্টেম গড়ে তোলা হয় যাতে রিপু দ্বারা কেউ পরিচালিত না হয় কিংবা পরিচালিত হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সিস্টেম গড়ে তোলার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে এদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে।
সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে যখন প্রাতিষ্ঠানিকতা থাকে ও সেটির চর্চা করা হয় তখন ব্যক্তির অপরাধের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে এবং কেউ অপরাধ করলে তার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার মধ্য দিয়ে অন্যদের জন্য উদাহরণ তৈরি করা সহজ হয়। এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা রোধ করা সম্ভব হয়। কিন্তু মতিউর, বেনজীর ও আজিজের যে অর্থ সম্পদের ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে তারা দীর্ঘকাল ধরে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় অর্থ সম্পদ আহরণ করেছেন এবং তাদের রিপু দমনে প্রাতিষ্ঠানিকতা কাজ করেনি বা করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তর থেকে যে বাধা আসার কথা ছিল কিংবা অপরাধের শুরুতেই যে সতর্কতা নেওয়া দরকার ছিল সেগুলো হয়নি। এমনকি অবৈধ অর্থে দেশের অভ্যন্তরে যেসব জনপদে ও সমাজে দৃশ্যমান সম্পত্তি, রিসোর্টসহ ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন সামাজিকভাবে সেখানেও কোনো ধরনের প্রতিরোধ বা বাধার সম্মুখীন হননি।
এই প্রেক্ষাপটে যারা বিষয়টিকে ব্যক্তির অপরাধের চেয়েও বেশি সিস্টেমের দুর্বলতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন তারা দু'টো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসছেন—এক. রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় ব্যবস্থাপনাগত ঘাটতি ও সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতার অনুপস্থিতি; যার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়েও ব্যক্তির ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে।
দুই. দেশের মালিকানা জনগণের হাতে না থাকা। শেষোক্ত কারণে মতিউর, বেনজীর ও আজিজ প্রমুখদের দীর্ঘকাল ধরে সম্পত্তি ক্রয় ও সম্পদের বিস্তারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারেনি; দেশের মালিকানা জনগণের হাতে থাকলে এই ধরনের বিষয়গুলো আরো আগেই প্রকাশিত হতো এবং দেশ ও দেশের মানুষ বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারতো।
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন