তিস্তা নিয়ে শেখ হাসিনার নতুন চাল
আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে যারা দেশ ও দেশের বাইরে থেকে নানা বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা লেখ্য ও অডিও-ভিজুয়্যাল মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করেন তাদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তারা বরাবরই সরকারের সক্ষমতাকে ছোট করে দেখাতে চান। বিভিন্ন সময়ে নিজেদের কথাবার্তায় তারা এমন একটি ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করেন যাতে মনে হয়, সরকার খুবই দুর্বল হয়ে গেছে। নানা দিক থেকে এমনসব তৎপরতা শুরু হয়েছে যেগুলো সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। সেনাবাহিনীর ভেতরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ঋণ জোগাড় করতে পারবে না। মার্কিন কর্মকর্তাদের গতিবিধি সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস মুখ খুলতে শুরু করেছেন। মার্কিনিরা সাংবাদিক সম্মেলনে বাঁকা কথা বলছে। বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম বাড়ছে। হেফাজত-জামায়াতের কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। চীন-ভারতের মধ্যে লেগে গেছে। অতএব, সরকার আর বেশি দিন টিকবে না।
এই মনোভাব সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল তো বটেই সরকার সমালোচক রাজনৈতিক সমালোচক ও বিশ্লেষকদের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টানা চতুর্থবারের মতো চাতুর্যপূর্ণ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষীগত করার পর এসব কথা এখন খোলাখুলি বলা দরকার।
কেননা চতুর, ধাপ্পাবাজ, দালাল ও ক্ষমতাধর শক্তির বিরুদ্ধে শুধু উইশফুল থিংকিং ও প্রোপাগান্ডা দিয়ে জেতা সম্ভব নয়। যারা এই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তাদের লড়াই, ত্যাগ ও আকাঙ্ক্ষাকে ছোট করে দেখা যাবে না অবশ্যই। কিন্তু, প্রতিপক্ষকে আন্ডারএস্টিমেট করে কৌশল সাজালে তাতে জয়ের সম্ভাবনা কমে আসে। তাই সবার আগে দরকার, আওয়ামী লীগের সক্ষমতা সম্পর্কে যথাযথ পর্যালোচনা। কোথায় তাদের সক্ষমতা তা চিহ্নিত করলে নিজেদের দুর্বলতার জায়গাগুলোও বোঝা সম্ভব। কোথায় সরকারের দুর্বলতা তা নিয়ে চর্চা করলে তাতে সফলতা আসবে না। তাতে বরং সরকার সচেতন হয়ে নিজের দুর্বল জায়গাগুলোকে সংশোধন করার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ আলোচনা করা যায়। আওয়ামী রেজিম বিরোধীরা গত তিন আমলের ১৫ বছর জুড়েই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নানা হস্তক্ষেপের আশা করেছেন। তারা মনে করেছেন, দায়িত্বশীল, শক্তিশালী ও দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ভূমিকা রাখবে। কিন্তু আদতে তা হয়নি। নানা সময়ে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দেশে ও দেশের বাইরে থেকে সেনাবাহিনী সম্পর্কে নানা আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন, বাহিনীর ভেতরের নানা অসন্তোষের খবর দিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে বাহিনীগুলোর টানাপোড়েনের কথা চাউর করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এসবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ছয়জন সেনাপ্রধান দায়িত্ব শেষ করেছেন। পিলখানা ট্র্যাজেডির সময়ের অসন্তোষ ছাড়া এই সরকারকে তেমন কোনো অসুবিধা পোহাতে হয়নি। বরং এই সময়ে সরকার সেনাবাহিনীর মধ্যে একটা প্যারাডাইম শিফট ঘটাতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতাপিয়াসী সেনাবাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিচিতি ছিল। এখন বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের আকাঙ্ক্ষাকে প্রশমিত করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছেন। এখনকার সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে শেখ হাসিনার পাশাপাশি তুর্কিয়ের রাষ্ট্রপতি রেসিপ তাইয়েব এরদোয়ানই এরকম সাফল্য দেখাতে পেরেছেন বলে মনে করা হয়। ফলে, এই সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে যে বা যারাই বিরোধীদের মধ্যে ফলস হোপ ছড়িয়েছেন তারা মূলত গুজববাজ বা সরকারেরই নানা উদ্দেশ্য সফল করেছেন। এমনকি র্যাব ও অন্য বাহিনীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেনাবাহিনী অংশগ্রহণ নিয়ে যারা নানা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন তাদের সেসব আশাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এদিক থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিরোধীদের বিভ্রান্ত করে বড় একটি স্ক্যামের জন্ম দিয়েছেন।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিরোধীদের বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে, সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ সম্পর্কে ভুল ধারণা। মার্কিন কূটনীতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জানাশোনার অভাবই এই ধারণা তৈরির পেছনে কাজ করেছে বলে মনে হয়। মার্কিনীরা সবসময় বহুমাত্রিক কূটনীতি পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালে মার্কিনীরা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সেদেশের অনেকে সিনেটর বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এমনকি ঢাকায় অবস্থানরত তখনকার কূটনীতিকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশী শরণার্থীদের মার্কিনিরা ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। মার্কিন নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। কেউ যদি পাকিস্তানকে সমর্থনের মার্কিন মূলনীতিকে বিবেচনায় না নিয়ে বিশ্লেষণ করতে থাকেন তবে তিনি সহজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই পারেন যে মার্কিনীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই ছিল। কিন্তু আসলে কি তাই?
না।
বাংলাদেশের এখনকার প্রেক্ষাপটেও বিষয়গুলোকে সেভাবেই দেখতে হবে। মার্কিনিরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছে, র্যাবের ওপর স্যাংশন দিচ্ছে, বিরোধীদের সঙ্গে দেখা করছে, তার মানে এই নয় যে তারা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-কেন্দ্রিক নীতি থেকে সরে এসেছে। এখন কেউ যদি মার্কিনীদের প্রশ্ন করেন, আপনারা কি ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেন, তাহলে উত্তর কী হবে?
হা দেখি?
এতটা বোকা উত্তর কেউ দিতে পারে?
অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীতি পরিবর্তন করে ভারতের চোখ দিয়ে নয়, নিজের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখতে শুরু করেছে এই বিশ্লেষণ যারা প্রথম হাজির করেছেন তারা বড় একটি স্ক্যামের জন্ম দিয়েছেন। এখান থেকে বহু ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে। বিশ্লেষকদের এসব ভুল ধারণা বিরোধীদের বিভ্রান্ত করেছে। ফলস হোপ দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর কাজ করেছে নির্বাচনের আগে। তারা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মাতে পেরেছিল যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য তারা পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপই তারা নেয়নি। নির্বাচনের পর তারা জানিয়ে দিয়েছে, এ অঞ্চলে ভারতের নেতৃত্বের প্রতিই তারা আস্থাশীল। কেউ কেউ মনে করেন, মার্কিন প্রশাসনের ভেতরে কেউ কেউ বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারকে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় রাখার জন্য কাজ করেছে। আবার অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তরিক থাকলেও এদেশে ভারতীয় প্রভাব তাদের উদ্যোগগুলোকে সফল হতে দেয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, হোয়াইট হাউসের নীতি ইতিবাচক ছিল, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসও আন্তরিক ছিল কিন্তু মাঝের কর্মকর্তারা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। ঘটনা যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর ব্যাপারে ভারতের নীতির বাইরে গিয়ে কোনো আন্তরিক পদক্ষেপ নেবে না এটা ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর একেবারে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবু নির্বাচনের পর তাদের অনেক দিনের নিরবতার পর সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার সূত্রে কোনো কোনো বিশ্লেষক ধারণা দিতে শুরু করেছেন যে, এই প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে চলবে। নতুন করে ফলস হোপ ছড়ানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এগুলো বিরোধী আন্দোলনে আর নতুন কিছু যোগ করতে পারবে না, বরং আন্দোলনকেই দুর্বল করে দেবে।
অবশ্য এ কথাও শোনা যাচ্ছে যে, সম্প্রতি বেনজীর আহমেদ, আছাদুজ্জামান মিয়া, আজিজ আহমেদ, মতিউর রহমান সহ বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তার সম্পত্তির যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে তার পেছনে মার্কিন প্রভাব কাজ করছে।
যারা এসব কথা বলছেন, তারা শেখ হাসিনা সরকারকে আন্ডারএস্টিমেট করছেন। তারা মনে করছেন, এ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে সরকার দুর্বল হয়ে যাবে। প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের কাছ থেকে আগের মতো সমর্থন পাবে না। ফলে, সরকার দুর্বল হয়ে যাবে।
এই বিশ্লেষকরা আওয়ামী লীগের কর্মপদ্ধতি খেয়াল করেন না বলেই এমন কথা বলতে পারেন। আওয়ামী লীগ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কখনোই শত্রুজ্ঞান করেনি, বরং নানা কথা বলা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে মোটামুটি ভাল সম্পর্ক রেখে এসেছে। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ, জঙ্গী ও ইসলামপন্থীদের দমনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় পার্টনার। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর নীতি তারা ভালোভাবেই অনুসরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শিক পার্টনার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে তারা এই প্রতীতি জন্মাতে পেরেছে যে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তারাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। ফলে, নীতিগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের বড় কোনো বিভেদ নেই। মূল জায়গাগুলো ঠিক রাখার কারণে সরকারকে দূরে ঠেলে দেওয়ার মতো কোনো কারণও তৈরি হয়নি মার্কিনীদের পক্ষ থেকে।
দেশের বাইরে সরকারের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। দেশের ভেতরেও নেই। এই সরকারের আমলে যেমন ছয়জন সেনাপ্রধান দায়িত্ব শেষ করে অবসরে গিয়েছেন তেমনি পুলিশ, আমলাতন্ত্রের মধ্যেও একটা নতুন জেনারেশন তৈরি হয়েছে। বড় বড় কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন কালে নিজেদের অপরিহার্য হিসেবে হাজির করেছেন বটে, কিন্তু সরকারের জন্য কেউ অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি। একটা সিস্টেম এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে যে কেউ এই সিস্টেমে সরকারের স্বার্থকেই নিজেদের স্বার্থ মনে করে। দুর্নীতি করার সুযোগ ও দলীয়করণের মাধ্যমে সব ক্ষেত্রেই এমন এক কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে যাতে কেউই সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে না পারে। কোনো বাহিনী মনে করতেই পারে যে তারাই সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে। এজন্য সুবিধাও নিতে পারে। কিন্তু তারা সরকারের ওপরে গিয়ে কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। কেননা তারা প্রত্যেকেই দুর্নীতিগ্রস্থ। এর বাইরে গত ১৫ বছরে পুলিশ ও প্রশাসনে নতুন মতাদর্শের নতুন প্রজন্ম তৈরি করা হয়েছে। যারা সরকারের নতুন ফোর্স হিসেবে কাজ করছে।
একথা ঠিক, বেনজীর ও আজিজ সরকারকে অনেক সহায়তা করেছেন। কিন্তও অবসর গ্রহণের পর এখন তাদের উপযোগিতা কী? কিছুই না। বরং তারা সরকারের জন্য বার্ডেন। তাদের বিপুল দুর্নীতির হাজার হাজার কোটি টাকার রক্ষার দায়িত্ব তো সরকারের না। দুর্নীতির অবাধ সুযোগ যতই থাকুক, কোনো সরকারই কি চাইবে সরকারি কর্মকর্তারা শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের পর্যায়ে টাকা অর্জন করুক? আর তারা নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক? দুর্নীতি থেকে অর্জিত টাকার ভাগ কি রাজনৈতিক নেতারা চাইবেন না?
এর আগে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর সরকার-সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? বিকল্পহীন বলে পরিচিত কোনো কোনো নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কি সরকার দুর্বল হয়েছে? হয়নি। বরং, সরকার জনসমর্থন পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের ভেতরে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। তা কি হয়েছে?
করোনা কেলেঙ্কারির সময় কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সরকারের সমর্থন বেড়েছে। এবারে যে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চলছে তাতেও কিন্তু পরোক্ষভাবে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সুপরিচিত দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে সরকার যেমন অভিযোগের তীর নিজের দিকে আসতে দিচ্ছে না, তেমনি হারানো জনসমর্থন কিছুটা হলেও ফেরাতে পারছে। পাশাপাশি, প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যে যে বেপরোয়া ও বিদ্রোহী মনোভাব দেখা দিয়েছিল তাও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে।
শুধু আজিজ বেনজীর নন, উপযোগীতা শেষ হওয়ার পর শেখ হাসিনা ইনু-মেনন-দীলিপ বড়ুয়াকে ছুঁড়ে ফেলেননি? জাতীয় পার্টির নেতাদের ভিক্ষুকে পরিণত করেননি? তার নিজের দলের যে নেতারা এককালে শেখ হাসিনার জন্য হুমকি ছিলেন তাদের একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলে দেননি?
আপাত অর্থে মনে হবে, আওয়ামী লীগের একই নেতারা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু ভালভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, তা মোটেও নয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে শেখ হাসিনা কনস্ট্যান্ট থাকলেও তার নিচে নতুন মুখের সমাবেশ ঘটেছে। এমনকি পরিবারেও তিনি কারো রাজনৈতিক অভীপ্সাকে খুব বেশি বাড়তে দেননি। নিজের ক্লোজ পরিবারে কেউ তার উত্তরাধিকার হিসেবে সামনে আসতে পারেননি। বৃহত্তর পরিবারের সেলিম-হেলাল-তাপস-পরশ-সেরনিয়াবতদের হাতে রাজনীতি বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। তারা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার কার্যত জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
তাহলে কি শেখ হাসিনা একাই সরকার চালান?
না।
তিনি একটা ডিপ স্টেট গড়ে তুলেছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে যারা রাষ্ট্র চালান তাদের হয়তো কেউ চেনেন না। তাদের নামও জানেন না।
কীভাবে একটা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র চালাতে হয় সেটা এখন শেখ হাসিনার নখদর্পণে। মাঠের রাজনীতির প্রতিপক্ষদের তিনি সাম-দান-দণ্ড-ভেদ নীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। তার আমলে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শুধু যে, রাশেদ খান মেনন, দীলিপ বড়ুয়া ও হাসানুল হক ইনুর দলকেই তিনি উপঢৌকন দিয়ে দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন, তাই নয়। অন্য বামপন্থী দলগুলোকেও তিনি বন্ধুত্ব ও উপঢৌকনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। সর্বোপরি, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে আওয়ামী লীগের মতাদর্শ ও রাজনৈতিক এজেন্ডা এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এদের মধ্যে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সুযোগ-সুবিধা না নিলেও আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের আদর্শই ধারণ করে। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনকে তিনি নিজের আওতার মধ্যে লালন-পালন করেছেন। জামায়াতে ইসলামীকে দমন করেছেন। জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজ ব্যবহার করে দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। হেফাজতের নরমপন্থী অংশকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন উপঢৌকন দিয়ে। বিদ্রোহী অংশটিকে দমন করেছেন। অনেকেই মনে করেন, বিএনপি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। কিন্তু যে স্টেট মেশিনারিজ সবকিছুকে কিনে ফেলতে, নিয়ন্ত্রণ করতে এবং দমন করতে পারে তারা কি বিএনপির মতো দলকে অবাধে ছেড়ে দিয়ে বসে আছে ১৫ বছর ধরে?
যত কথাই বলা হোক, গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়ে গেছে, ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি গণআন্দোলনকে সফলতার মুখ দেখাতে পারবে না। এ কারণে মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্য আর কোনো বড় চ্যালেঞ্জ নেই। রাজনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বড় একটি রূপান্তর ঘটাতে পেরেছে। এবং চতুর্থ দফা মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে কতটা কার্যকর থাকতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেননা, নেতারা জনগণের দাবি-দাওয়া সামনে আনতে পারছেন না। তারা ক্ষমতায় এলে কী করবেন জনগণের সামনে সেটি বলতে পারছেন না। দীর্ঘ সময় বিরোধী রাজনীতি করার পরও বিএনপি শক্তিশালী বিকল্প ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কি অপরাজেয় হয়ে গেছে?
না।
কেউই অপরাজেয় নয়। সরকার নিজের তৈরি করা সমস্যাতেই জর্জরিত। অর্থনৈতিক সমস্যা সত্যিই ঘণীভূত হয়েছে। অর্থনীতির সব সূচকে ধ্বস নামতে শুরু করেছে, রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছেছে, বাজারদর মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। বিদ্যুৎ, তেল-গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত মাফিয়া সিস্টেমে একটা লুটপাটতন্ত্র সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। ব্যাংক, বাজার, আমদানী, রপ্তানি সব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর এই সিন্ডিকেটই কার্যত সরকার হিসেবে কাজ করছে। ফলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে এ থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। অর্থনীতিকেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের কাছে বড় বড় ঋণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে পরিস্থিতি তাতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, এডিবি বড় বড় ঋণ প্রকল্প নিয়ে হাজির হবে তা ভাবার যুক্তি নেই। সরকারকে চীন ব্লাইন্ড লোনের ওপর নির্ভর করতে হবে। কেননা, চীন জুয়ার বড় দান খেলার মতো করে বড় ঋণ দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নীতিতে বিশ্বাসী। অনেকেই মনে করেন, ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই সরকারকে চীন ঋণ দেবে না। তার ভুলে যান, ঋণ চীনের অস্ত্র, চ্যারিটি নয়। তারা এই অস্ত্র প্রয়োগ বন্ধ করবে না। তাছাড়া চীন বাংলাদেশে ব্যবসা ভাল করছে।
তিস্তা প্রকল্প সরকার তাদের দিক বা না দিক তারা ঋণ দিয়ে যেতে থাকবে। সরকারকে চীননির্ভর করে তোলার সব ব্যবস্থাই করবে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যাই বলুক, চীনের ঋণের শেষ পরিণতি হলো পুরোপুরি চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া।
ভারত সফর করে দেশে আসার পর শেখ হাসিনা সর্বশেষ যে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন সেটিকে অনেক বিশ্লেষক ভুলভাবে পর্যালোচনা করছেন। তারা শেখ হাসিনার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখতে পেয়েছেন। প্রকৃত ঘটনা কিন্তু উল্টো। শেখ হাসিনাকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী দেখা গেছে এবার। শুধু তাই নয়, তিনি আত্মবিশ্বাস সহকারে ভয়াবহ সব কথা বলেছেন। ড. মুহম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তিনি ঠান্ডা মাথায় একটি ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন। তাকে বিতর্কে আহবান জানিয়েছেন। ড. ইউনূস কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এই আহবানে সাড়া দিতে পারেননি। এর আগে শেখ হাসিনা যখন বিদেশী বিবৃতিদাতাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়াগুলো দেখে যেতে আহবান জানিয়েছিলেন তখনও তাৎক্ষণিকভাবে ইউনূস সমর্থকরা সাড়া দিতে পারেননি। অনেক পরে দিলেও সরকার সেটি নাকচ করে দেয়। এবারও ড. ইউনূস পিছু হটলেন। অবস্থা দেখে মনে হয়, ড. ইউনূসের বড় বড় অবদান সত্ত্বেও মার্কিন রাজনীতিতে তার প্রভাব এখন অনেক কমে গেছে। তার মতো সাবধানী, আত্মকেন্দ্রিক, ভাবুক, দার্শনিক ধরনের মানুষকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভব অনেক কিছুই করবে। কিন্তু এর জন্য কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবে না, যা আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদে ফেলবে।
সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা অনেক কথাই বলেছেন। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতীয় ন্যারেটিভটি তিনি একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার শামিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে আসার পর ভারত সরাসরি যুদ্ধে নেমেছিল। ভারতীয় বাহিনী সহযোগিতা করেছে। কিন্তু তারা স্বাধীনতা এনে দিয়েছে বলাটা সত্যের অপলাপ। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই কথাগুলো বারবার বলতে শুরু করেছে। সেটা কি শুধু ভারতকে বন্দর, ট্রানজিট, করিডোর, রেল দেওয়ার যুক্তি তৈরি করতে নাকি আরও বড় কারণ আছে সেটা জানতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। শেখ হাসিনা যেমন গত তিন মেয়াদে নিজের ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছেন, দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন, প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবাহিনীতে নিজের পক্ষে নতুন জেনারেশন তৈরি করেছেন, সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সবদিকের সম্ভাব্য সব হুমকি প্রশমিত করেছেন তেমনিভাবে ভারতও প্রত্যেক মেয়াদে বাংলাদেশের ভেতর নিজের প্রভাব বাড়িয়েছে। প্রথমে তারা নিজেদের নিরাপত্তা হুমকিগুলোকে প্রশমিত করেছে, ভারত-বিরোধী বড় শক্তিগুলোকে দমন করেছে, প্রশাসনে ভারতপন্থীদের শক্তিশালী করেছে, ভারতপন্থী সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করেছে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারতপন্থী নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্য ও অপ্রাপ্য সকল সুবিধা নিয়েছে, সর্বোপরি সরকারকে পুরোপুরি ভারত-নির্ভর করে তুলেছে। চতুর্থ দফায় তাদের চাওয়া নিশ্চয়ই নতুন মাত্রায় যাবে। সেটা কী হতে পারে, তা হয়তো সকালের সূর্য দেখে অনেকেই হয়তো অনুমান করতে পারছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা তিস্তা প্রকল্প নিয়ে যে চালটি দিয়েছেন সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ভারতকে নাখোশ করেননি। কিন্তু টাকা তো তার সত্যি দরকার। ভারত টাকা দেবে না। টাকা দেবে চীন। তিনি বলেছেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারত চীন দুই দেশই আগ্রহী। ভারত আগ্রহী হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তিনি দেখবেন কার ঋণের শর্ত ভাল, কে ভাল প্রস্তাব দিচ্ছে। কাজ তিনি তাকেই দেবেন। আখেরে মনে হচ্ছে, তিস্তা নিয়ে ভারত-চীনের টানাটানিকে তিনি কাজে লাগাতে চাইছেন। এ নিয়ে কোনো পক্ষে না ঝুঁকে তিনি দুই পক্ষকে ঝুলিয়ে রেখে আরও বেশ কিছুদিন লেজে খেলাবেন। এ নিয়ে বার্গেইন করবেন।
কিন্তু চতুর্থ দফার আওয়ামী লীগ শাসন আমলে ভারত বেশ মরিয়া। তার বড় কিছু চায়। ভারতের এই মরিয়াপনা সম্পর্কে চীন আঁচ করতে পারছে। তাই তারাও বেশ সক্রিয়। বাংলাদেশে ভারতের বৃহত্তর উদ্দেশ্য চীন বিনা চ্যালেঞ্জে বাস্তবায়িত হতে দেবে বলে মনে হয় না।
বিশ্লেষকদের উদ্দেশে একটা কথাই বলার, তলে তলে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ১৫ বছর আগে আপনার বয়স ৪০ হলে এখন ৫৫ হয়েছে। নিজের পাকা চুলের দিকে তাকান। আপনি না জানলেও এই পাকা চুলগুলো অন্তত জানে, আওয়ামী লীগ সরকার কতটা পেকেছে।
প্রতিপক্ষের ক্ষমতা সম্পর্কে জানুন। তাকে সেভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করুন। ফলস হোপ দিয়ে এই ক্ষমতাকে হটানো যাবে না।