শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে হবে
খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়েই এ লেখা লিখতে শুরু করলাম। গত কয়েকদিনে ইউটিউবে সরকার-বিরোধী বলে পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তির টকশো ও বিশ্লেষণ দেখে এই উদ্বেগ তৈরি হলো। একটি টকশোতে উপস্থাপক ও আলোচক মিলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন আন্দোলনকে তুলোধুনো করছিলেন। তারা বারবার বলছিলেন, ফ্যাসিবাদী-কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও দাঁড়াননি। তাই শিক্ষকদের এ আন্দোলনকে সমর্থন করা যাবে না। শিক্ষকরা দেশের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত নন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে তারা রাস্তায় নামেননি। তারা শুধু নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্য মাঠে নামেন। সরকারের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেন। তাই তাদের আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া যাবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আলোচনাটিকে একদেশদর্শী মনে হলো। উপস্থাপক ও আলোচকরা হয়তো ভুলে গেছেন আওয়ামী লীগের নিবর্তনমূলক ১৫ বছরের শাসনামলে তাদের নীতির বিরোধিতা করে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নাজেহাল হয়েছেন, অসম্মানিত হয়েছেন, আক্রমণের শিকার হয়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন। সরকারের নানা চাপ, ছাত্র সংগঠনের মাস্তানি, নানা বঞ্চনা-লাঞ্ছনার ভয় সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কম প্রতিবাদ করেননি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনেক প্রতিবাদী কণ্ঠ আমরা শুনতে পেয়েছি।বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা সম্মিলিতভাবে বহু অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। সারাদেশে কমপক্ষে ৩০ জন বিরোধী মতের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। এদের মধ্যে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম, ঢাবির অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, অধ্যাপক ড. এমরান হোসেন, অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. নুরে আলম সিদ্দিকীসহ আট শিক্ষক চাকুরি হারিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মেয়ে লালরুখ মির্জা বিদেশে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে ফিরে এলেও ঢাবির চাকুরিতে যোগদান করতে পারেননি। এছাড়া বিএসএমএমইউর কমপক্ষে ৩০জন শিক্ষক নির্যাতন, নিপীড়নের মুখে চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সব মিলিয়ে সারাদেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে আসিফ নজরুল, তানজিম উল ইসলাম, আ-আল মামুন, রায়হান রাইন, সামিনা লুৎফা, গীতি আরা নাসরিন, মাঈদুল ইসলাম, ফাহমিদুল হক, মোশাহিদা সুলতানা ঋতু, জিএইচ হাবীব, সিআর আবরার, আনু মুহাম্মদসহ বহু শিক্ষক বহুবার এই সরকারের বহু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন। কোটা সংস্কার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন যুগিয়েছেন। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৫০০ শিক্ষকের নাম বলা যাবে। কিন্তু সরকার বিরোধী বলে পরিচিত পর্যালোচকরা একজন শিক্ষককেও খুঁজে পেলেন না। যা খুবই দুঃখজনক।
তাছাড়া শিক্ষকদের সম্পর্কে তাদের ধারণাও অস্পষ্ট। তারা মনে করেন, এই আমালে সব শিক্ষক সরকার দলীয় হয়ে গেছেন এবং দুহাতে এন্তার কামাই করছেন। আসলে কি তাই?
তা নয়।
বরং আর সব পেশাজীবীদের মতো অধিকাংশ শিক্ষকই নির্দিষ্ট আয় দিয়ে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করতে পারছে না। যারা দল করছেন না তাদের পক্ষে বাড়তি সুবিধা বা পোস্টিং জোগাড় করা কঠিন। যারা দল সমর্থন করেন তাদের সবাই কি সব সুবিধা পান?
আরেকটি আলোচনায় দেখলাম, আলোচক নানা বিশ্লেষণ করে জনগণকে দোষারোপ করছেন। জনগণ কেন জেগে উঠে প্রতিবাদ করছে না এজন্য জনগণের জ্ঞান ও স্মৃতিতে দোষারোপ করছেন।
এভাবে জনগণের মতো বড় একটি অংশ বা শিক্ষকদের মতো বড় একটি পেশাজীবী গোষ্ঠীকে কি ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা যায়? বিরোধী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কি সেটি করতে পারেন?
আরেকজন বিরোধী বিশ্লেষক বলছেন, ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এটা ক্ষুদ্র স্বার্থে পরিচালিত আন্দোলন। এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই আন্দোলন জনগণের মুক্তির আন্দোলন বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারবে না। প্রশ্ন হলো, তাহলে কি শিক্ষার্থীরা নিজেদের চাকরির জন্য স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বাদ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করবে? এই মুহূর্তে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে তারা সরকারের কাছে দাবি জানাতে পারবে না? শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য পেনশন দাবি করে মাঠে নামতে পারবে না?
পারা উচিত।
বরং সরকার বিরোধী বলে পরিচিত এই পর্যালোচক ও আলোচকদের উচিত নিজেদের বক্তব্য পরিবর্তন করা। কেননা, এ ধরনের বক্তব্য তাদের হতাশাকে উন্মোচিত করে দেয়। এটা সত্য, দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে তারা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হয়তো তাদের শেষ আশাও ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। কিন্তু এ কারণে জনগণের ওপর বা ঢালাওভাবে পেশাজীবী গোষ্ঠী বা ছাত্রদের ওপর রাগান্বিত হওয়া উচিত নয়। কেননা, এই আন্দোলনগুলো চরিত্রের দিক থেকে গণতান্ত্রিক। এগুলো মানুষকে জেগে ওঠার প্রেরণা জোগায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে ছাত্র সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিল সেকথা আমরা ভুলে যাইনি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন অনেক আশা জাগিয়েছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি সহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনও কম আশা জাগায়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে সব শেষ হয়ে যায়নি। ফলে, জনগণকে দোষারোপ করা যাবে না। বরং নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি এলে এক লুটেরা শ্রেণীর জায়গায় আরেক লুটেরা শ্রেণী যে প্রতিস্থাপিত হবে না জনগণকে সেকথা বোঝাতে হবে। পরিবর্তনের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে জোরদার করতে হবে।
পেশাজীবী আন্দোলনকে নেতিবাচকভাবে দেখার প্রবণতা বাম রাজনীতির সঙ্গে বিরোধীদের রাজনীতিতে ঢুকেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বামপন্থীদের কিছু অংশ বলেছিল, এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি আসবে না। তারা যুদ্ধে জড়ায়নি। কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তি তো একবারে আসে না। মানুষ সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধে জড়ায়। সামর্থ্য অনুসারে বিজয় অর্জন করে। চূড়ান্ত বিজয় দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার।
বামপন্থীদের কথা শুনে ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান সহ সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী সেনানায়করা যদি নয় মাস যুদ্ধ পরিচালনা না করতেন তাহলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো। কিন্তু পুরো ক্রেডিট নিতো ভারতীয় সেনাবাহিনী। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস লড়েছিলেন বলে আজ আওয়ামী লীগ ও ভারত পুরো মুক্তিযুদ্ধের ক্রেডিট চুরি করতে পারছে না। দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে আবার। বামপন্থীদের অন্তর্ঘাতমূলক তত্ত্ব কথায় কান না দিয়ে বিএনপি সহ বিরোধী দলেগুলোর উচিত সকল পেশাজীবী, ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে অংশ নেওয়া। ন্যায্য দাবির পক্ষে আওয়াজ তোলা।
পাশাপাশি, যে বিশ্লেষকরা দেশের বাইরে থেকে ক্রমাগত হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন তাদের উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া।
কেননা জনগণকে দোষারোপ করে কখনো সফল হওয়া যায় না।