সুশাসনের অভাবে ঢাকার ফুটপাথ বেদখলে
আওয়ামী লীগের বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে ঢাকা শহরে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুটপাথ তৈরি হয়েছে। মেট্রো স্টেশনগুলোকে ঘিরে চমৎকার সব ফুটপাথ গড়ে উঠেছে। সেখান দিয়ে হাটলেই মন ভালো হয়ে যায়।
শুধু মেট্রোস্টেশনকে ঘিরে বলব কেন, ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কগুলোর পাশের ফুটপাথ ভেঙ্গেচুরে নতুন ইট দিয়ে আবার তৈরি করা হয়েছে। বাদ যায়নি পাড়া মহল্লার ফুটপাথও। অলিতে গলিতেও পুরাতন ফুটপাথ ভেঙ্গে আধুনিক ইট দিয়ে নতুন নতুন ফুটপাথ তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার চিপা ফুটপাথ চওড়া করা হয়েছে।
ঢাকায় এখন ন্যূনতম রিকশা ভাড়া ২০ টাকা। ৫ বছর আগেও যে দূরত্ব ২০ টাকায় যাওয়া যেতো সেই দূরত্ব এখন রিকশায় যেতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দিতে হয়। এদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও হু হু করে বাড়ছে। এসব কারণেও এখন ঢাকার ফুটপাথে হাঁটার মানুষের সংখ্যাও বহু গুণে বেড়েছে। তাছাড়া অপরিকল্পিতভাবে ক্রমাগতভাবে বেড়ে উঠা ঢাকা শহরে যারা একটু স্বাস্থ্য সচেতন, তাদের হাঁটার জন্য ঢাকায় পর্যাপ্ত পার্ক ও মাঠ না থাকায় তাদের হাঁটার একমাত্র উপায় হলো পাড়া মহল্লার কিংবা বাড়ির কাছের ফুটপাথ।
সবমিলিয়ে বলা যায় ঢাকায় ফুটপাথের চাহিদা বেড়েছে!
এদিকে ঢাকায় যে নতুন নতুন ফুটপাথ ও সেসঙ্গে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করার প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ায় ঢাকাবাসী তাদের আবাসস্থল ভেদে তিন মাস থেকে ৯ মাস পর্যন্ত নিদারুণ কষ্ট করেছে। কোথাও রাস্তা খুঁড়ে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়েছিল। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা এখনো কোথাও কোথাও চলতে দেখা যায়। কারণ ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী ও ইতিহাসের পাতায় ৪০০ বছরের পুরনো শহর হলেও, একটি নতুন শহরের মতোই এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। ঢাকা শহরে রাস্তা খোড়াখুড়ি আর নতুন করে রাস্তা মেরামত আর সেসঙ্গে ফুটপাথ তৈরি প্রায় সারাবছর ধরে কোথাও না কোথাও চলতেই থাকে। ঢাকার বায়ুর মান যে বিশ্বের নিকৃষ্ট বায়ুমানের দিক থেকে উপরের দিকে সেটার অন্যতম বড় কারণ অবকাঠামোগত চলমান উন্নয়ন।
এদিকে ফুটপাথ মানুষের চলাচলের জন্য তৈরি করা হলেও আমার যেসব জায়গায় নিয়মিত চলাচল যেমন মিরপুর, পল্লবী, রূপনগর, গুলশান, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, শান্তিনগর, শান্তিবাগ, মালিবাগ, রামপুরা, নতুন বাজার, আগারগাঁও, কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, বিজয়নগর, পল্টন, ফকিরাপুল, রাজারবাগ, মগবাজার এলাকায় দেখি নতুন করে তৈরি করা ফুটপাথগুলো জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকানপাট ও ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। সবমিলিয়ে ফুটপাথ যে কারণে তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ মানুষের হাঁটাচলার জন্য সেই উদ্দেশ্য প্রায় সকল ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
ঢাকা শহরের অনেক ফুটপাথ পাওয়া যাবে যেখানে প্রায় স্থায়ীভাবে গাছ বিক্রির নার্সারি তৈরি করা হয়েছে, পান বিড়ি সিগারেটের দোকান বসানো হয়েছে, রেস্টুরেন্টের চুলা বসানো হয়েছে, চটপটি ফুচকা খাওয়ার দোকান বসেছে, রিকশা সাইকেল রাখার স্থান তৈরি হয়েছে, সবজি বিক্রির দোকান বসেছে কিংবা অন্য কিছুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফুটপাথের জায়গা দখল করেছে।
ফুটপাথের এই দুর্দশা নিয়ে আমি যখনই কারো সাথে কথা বলি প্রথমেই যে কথাটি লোকজন বলে সেটা হল — মানুষ খুব খারাপ! তাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করি কোন মানুষ খারাপ? তাদের উত্তর হয় — ফুটপাথে যারা এই দোকানপাট, নার্সারি গড়ে তুলেছে তারা খারাপ।
এরপর যখন তাদের কাছে জানতে চাই— যারা পান বিড়ি সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনছে কিংবা রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে তাদের কোন দোষ নাই? তখন তাদের উত্তর হয় — দোকান থাকলে তো মানুষ জিনিসপত্র কিনবে!
তবে কেউ কেউ আছেন যারা মনে করেন — সুশাসনের অভাব থেকে ফুটপাথে এই দখলদারিত্ব গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাবানদের চাঁদাবাজি ও নিয়মিত আয়ের উৎস হিসেবে এই ধরনের দখলদারিত্ব গড়ে উঠেছে। তাদের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি হলো যেহেতু গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে মানুষ প্রতিনিয়ত ঢাকায় আসতেই থাকে, ফলে এই মানুষদেরকে ঘিরে এক ধরনের বাণিজ্য রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য, পাড়া মহল্লার ক্ষমতাধর ব্যক্তি, সিটি কর্পোরেশনের লোকজন সকলে মিলে মিশে আয়ের একটা নতুন ব্যবস্থা করে নিয়েছে এই ফুটপাথ থেকে।
আমি একসময় গুলশানের ১০৫ নাম্বার রোডের একটি বাড়িতে তিন বছরের কিছুটা বেশি সময় অফিস করেছিলাম। সেই সময়ে আমার অফিসের পাশে একটা ১০ তলা বিল্ডিংয়ের নির্মাণ শুরু হয়েছিল। সেই নির্মাণ কাজে নিয়োজিত থাকা শ্রমিকদের চাহিদাকে মাথায় রেখে একদিন সকালে দেখি এক লোক রাস্তার কোনায় একটি প্লাস্টিক বিছিয়ে চা, বিস্কুট, কেক, বনরুটি, সিগারেট বিক্রি করা শুরু করেছে। আমি সকাল সাড়ে সাতটায় অফিসে যেতাম। সেও ওই সময়ে আসতো। একদিন তার সাথে আলাপে জানলাম তার বেঁচা বিক্রি ভালো কিন্তু তাকে দিনে ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়, সে কারণে লাভটা তার সেভাবে থাকে না! এবং তার কাছ থেকেই জেনেছিলাম যে, অদূরে গামকা-র সামনের দোকানগুলো থেকে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র যমুনা ফিউচার পার্কে স্থানান্তরিত হওয়ার পর সেখানে ফ্ল্যাক্সে করে চা ও সিগারেট বিক্রি করা ছোট ছোট দোকানগুলোকে এককালীন ও দৈনিক একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। এবং ২/৩ মাস পর পর তাদেরকে একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে নতুন কাউকে আরো বেশি এককালীন টাকায় যমুনা ফিউচার পার্কের কাছাকাছি জায়গায় চা, সিগারেট বিক্রি করার সুযোগ দেয়া হয়।
আমি দুয়েকটা উদাহরণ দিলাম কিন্তু এটা পুরো ঢাকা শহরের ফুটপাথের চিত্র।
ঢাকা শহরের ফুটপাথগুলোতে গড়ে উঠা স্থায়ী ও অস্থায়ী ব্যবসাকে ঘিরে প্রতিদিন কতো কোটি টাকা হাতবদল হয় তার কোন পরিসংখ্যান জানা নেই। তবে চলার পথে একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় ঢাকার ফুটপাথের সাথে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আয় জড়িত। এবং ফুটপাথের যে অর্থনীতি সেখানে রাজনীতিও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। যারা ফুটপাথের এই বিষয়টি নিয়ে গভীরে গিয়ে ভাবেন তারা এই ফুটপাথ দখলের বিষয়টিকে সুশাসনের সাথে জড়িত বলে মনে করেন। তারা মনে করেন মানুষের ভোটের অধিকার হারানো এবং গণতন্ত্র সংকুচিত হয়ে আসার কারণে মানুষ রাষ্ট্রের নিয়ম কানুন তোয়াক্কা করছে না। সমাজের কোন শৃঙ্খলা বজায় থাকছে না। এবং মানুষ অন্যকে দেখে নিজে অপরাধে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। তারা জানেন না এর শেষ কোথায়।