বাংলাদেশের দুর্নীতি: উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে
৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়। তখন ভারতের মসনদে বসে ছিলেন রাজীব গান্ধী। মাতা ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু একটি দুর্নীতির অভিযোগ ও একটি স্লোগান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। সেই স্লোগানের ভাষা ছিল এ রকম- 'অলি গলি ম্যায় সোর হ্যায়/ রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়'।
সুইডেনের সঙ্গে একটি অস্ত্র চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে ঐ স্লোগানটির উৎপত্তি ঘটে। যা 'বোফর্স কেলেঙ্কারি' হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আর এই কেলেঙ্কারির কারণে '৮৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। সম্ভবত ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই প্রথম 'বোফর্ফ কেলেঙ্কারির মত একটি ঘটনা ক্ষমতার পট পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে কাজ করেছিল। সে সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সংবেদনশীলতা ছিল দেখার মত, যা নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছিল।
তবে সেখানে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য অটুট থাকায় জনগণের অভিমত প্রকাশের সুযোগ ছিল বলে শুধু একটি দুর্নীতির কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে জনগণ কংগ্রেসের মত দলকে শিক্ষা দিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু যেসব দেশে রাষ্ট্র ও সমাজে ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে এবং ন্যায়নীতি ভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের ভাবনা অলীক কল্পনায় পরিণত হয়েছে, সে সব দেশের অবস্থা কতটা করুণ হতে পারে তা সহজে বোঝা যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে, অর্থনৈতিক দুর্নীতিসহ নানা ধরনের কেলেঙ্কারির দায় কাঁধে নিয়ে অনেক সরকার প্রধান পদত্যাগ করেছেন। যেমন জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডের পদত্যাগের ঘটনা। এটা কোনো দুর্নীতি বিষয়ক কেলেঙ্কারি ছিল না। এটা ছিল একটি 'স্পাই কেলেঙ্কারির' ঘটনা।
সময়টা ছিল ১৯৭৪ সালের মে মাস। কোনো জল্পনাকল্পনা ছাড়াই আকস্মিক শান্তিতে নোবেলজয়ী উইলি ব্রান্ডের এই পদত্যাগ তখন বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল। কারণ তিনি যেন-তেন কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন জার্মানির অবিসংবাদিত নেতা, যার হাত ধরে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের উপর জেগে উঠছিল জার্মান জাতি।
সেই উইলি ব্রান্ড তার একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বিরুদ্ধে পূর্ব জার্মানির হয়ে গোয়েন্দাগিরি করার অভিযোগ ওঠায় নিজে পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে ৭৪ সাল, পদত্যাগ করার আগে পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। নিজে দোষী না হয়ে এভাবে পদত্যাগের ঘটনা বিরল। এটাকে তিনি মনিটরিংয়ের ব্যর্থতা হিসাবে নিয়েছিলেন।
শুধু অতীতের নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান কিংবা মন্ত্রী বা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগের ঘটনা আন্তর্জাতিক খবরে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরেই এই ২০২৪ সালের প্রথম দিকে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষাপটে পেরুর প্রেসিডেন্ট আলবার্টো ওটারোলা, ভিয়েতনামী সংসদের চেয়ারম্যান ভং দিন হিউ পদত্যাগ করেন। এর আগে গত বছর পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী এন্টিনিও কস্টা পদত্যাগ করেন কেবলমাত্র তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসায়।
এই কিছুদিন আগে দুর্নীতির অভিযোগে সিঙ্গাপুরের একজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সারা পৃথিবীতে এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু অনেক দেশ আছে যেখানে সর্বস্তরে দুর্নীতি উৎসবে পরিণত হলেও সেখানে এই অভিযোগে কাউকে পদত্যাগ করতে দেখা যায়নি। এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশ সামনে এসে যায়।
টিআইবি'র সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম হলেও আজও শোনা যায়নি যে, দুর্নীতির অভিযোগে কেউ পদত্যাগ করেছেন। বরং সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদসহ কয়েকজন পুলিশ এবং অন্যান্য কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এমনভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে কেবলমাত্র সরকারী কর্মকর্তারই দুর্নীতিগ্রস্ত, আর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ‘ধোয়া তুলসী পাতা’।
বাংলাদেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিষয়টি ওইভাবে বিচার করলে ভুল হবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দুর্নীতিই দুর্নীতি নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে- সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। কারণ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমেই দুর্নীতি সংঘটিত হয়।
বর্তমানে সর্বাত্মক ক্ষমতা প্রয়োগকারী সরকারের সহায়তা কিংবা সুযোগ প্রদান করা ছাড়া সরকারী কোনো কর্মকর্তার পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। সে করণেই সব দেশে দেখা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বই দুর্নীতির দায় কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করে থাকে। সুতরাং এখন বাংলাদেশে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তারা যখন পদে ছিল তখন তাদের উপরের যে সব রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল, তারাই হবে আগে দায়ী। কারণ হয় তারা অধস্তনদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের ব্যবহার করার লক্ষ্যে দুর্নীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন তাদের বলির পাঠা করা হচ্ছে! এ যেন 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ের' মত ঘটনা। সুতরাং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে বর্তমানের ভয়াবহ দুর্নীতির দায় থেকে মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন হবে।