প্রত্যয় স্কিম: স্মার্ট বাংলাদেশের উপকরণ নাকি বৈষম্যের উদাহরণ?

ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শনের আওতায় ২০৩১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার একটি কার্যকর অস্ত্র। সারা জীবন চাকরি করে যারা শেষ জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের বাইরে অবস্থান করতেন, তাদের সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে স্বস্তি প্রদানের লক্ষ্যে এটি প্রধানমন্ত্রীর একটি মহৎ উদ্যোগ। 

তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের সাথে যারা জড়িত তাদের অদূরদর্শিতা ও কিছু ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এই ব্যবস্থাটি আজ দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা-আন্দোলনের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যার ফলে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রায়োগিক দুর্বলতা ও নীতি প্রণয়নের অপরিণামদর্শিতার কারণে ব্যবস্থাটির সাফল্য আশঙ্কার মুখে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

চারটি স্কিম (প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা) নিয়ে শুরু করা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাটি শুরু থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেলেও একেবারে খারাপও করছিল না। প্রবাসী বাংলাদেশি, বেসরকারি কর্মচারী/প্রতিষ্ঠান, স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মী, এবং স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের অনেকেই এই ব্যবস্থায় যুক্ত হচ্ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে। কিন্তু গোল বেঁধে গেল স্বশাসিত, স্বায়ত্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে ‘প্রত্যয়’ স্কিমের আওতায় এই কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা যদিও মূলত সুগঠিত পেনশন কাঠামোর আওতার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য হওয়ার কথা ছিল, তবুও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে যাদের ইতোমধ্যে আবহমান কাল থেকে চলে আসা সুগঠিত পেনশন ব্যবস্থা আছে, তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা আছে; তবে বাধ্যতামূলকভাবে নয়। কিন্তু যেহেতু এখন সরকার চাইছে স্বশাসিত, স্বায়ত্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে এই কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করবে এবং তাদের অনেকেরই একটি পেনশন ব্যবস্থা আবহমান কাল থেকেই বিদ্যমান রয়েছে, তাই অবধারিতভাবে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হলো ‘প্রত্যয়’ স্কিমের সাথে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থার আর্থিক তুলনা ও এই স্কিমে শুধুমাত্র একটি শ্রেণির টার্গেটেড অন্তর্ভুক্তির ন্যায্যতা।

প্রথমেই আসা যাক বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থার সাথে ‘প্রত্যয়’ স্কিমের তুলনায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সবুজ ভৌমিক তার সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে এই বিষয়ে একটি চমৎকার তুলনা দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, একজন অধ্যাপক অবসরের সময় এককালীন প্রায় ৮১ লাখ টাকা পান। এই ৮১ লাখ টাকা তিনি যদি সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করেন, তাহলে তার মাসিক আনুমানিক আয় আসবে ৮১,০০০ টাকা। বর্তমান পেনশন পদ্ধতিতে একজন অধ্যাপক প্রতি মাসে প্রায় ৪৫,৭৯০ টাকা পেনশন পান। নতুন পেনশন পদ্ধতিতে বেতন থেকে যদি মাসে ৫,০০০ টাকা কেটে নিয়ে তা কিস্তিতে জীবন বীমা কর্পোরেশনের সাথে জীবন বীমা করা হয়, তাহলে পেনশন হিসেবে ৫৭ বছর বয়স থেকে আজীবন ৩২,৫০০ টাকা পাওয়া যাবে। এ ধরনের বীমার টাকা চাইলে অর্ধেক সমর্পণ করে এককালীন উত্তোলন করা সম্ভব, যার পরিমাণ হবে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এই টাকাও পুনরায় বিনিয়োগ করে আনুমানিক ১৬,০০০ টাকা আয় করা যাবে এবং বাকি অর্ধেক থেকে আজীবন পেনশন হিসেবে আসবে ১৬,২৫০ টাকা, যার মানে এককালীন ১৬,৫০,০০০ টাকা এবং মাসিক ৩২,২৫০ টাকা।

প্রধানমন্ত্রীর সুখী ও সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তাই সবচেয়ে সহজ উপায় হলো স্বশাসিত, স্বায়ত্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের পাশাপাশি অনাগত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও একটি অভিন্ন স্কিমের আওতায় এনে সেই স্কিমকে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থার নিদেনপক্ষে সমতুল্য করার নতুন নীতি প্রণয়ন করা। এতে সামাজিক সুরক্ষাও বজায় থাকলো, অন্তর্ভুক্তির বৈষম্যও দূর হলো, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহযোগিতার জায়গায় রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ‘এপারেটাস’ অটুট থাকলো।  

তবে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় শিক্ষকদের এই আন্দোলনের বাইরে গিয়েও কিছু কাজ করতে হবে। এই ক্রান্তিকাল আসলে আমাদের জেগে ওঠার জন্য একটি সতর্কবার্তা। আমরা শিক্ষকরা যখনই শিক্ষকতা আর গবেষণা বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নালিশ করা শুরু করলাম, একদল শিক্ষক নিয়ে আরেকদল শিক্ষককে তালাবদ্ধ করে রাখা শুরু করলাম আর তখনই নীতি-নির্ধারকরা বুঝে গেল এই শিক্ষক এখন তো আর সেই শিক্ষক নেই। একটা সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুনলে সবাই শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টিতে তাকাতো। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ ডিসেম্বরে যেসব বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন তার একটা বড় অংশ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেননা পাকিস্তানি বর্বর মাথামোটা সামরিক শাসক জানতো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান আর দেশসেরা মেধাবী কারা, কোথায় থাকেন তারা। আর তার পরের প্রজন্মের শিক্ষকরা আজ এমন এক অবস্থানে নিজেদের নিয়ে গিয়েছি যে, জাতির সেই সিংহপুরুষরা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো লজ্জিত হতেন। এই বিপথগামী শিক্ষকের সংখ্যাটা হয়তো খুবই অল্প, কিন্তু চোখে পড়ার জন্য যথেষ্ট। যার ফলে অন্য পেশাজীবীরাও ইদানিং ভাবতে শুরু করেছে এইসব শিক্ষকদের চেয়ে আমরাই যোগ্য, আমরাই বুদ্ধিমান। তাই যে পারে, সেই এসে দুকলম জ্ঞান দিয়ে যায়। 

এই খারাপ সময়ে শিক্ষকদের ঢাল হতে পারতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। কিন্তু তারাই এখন সবচেয়ে বেশি খড়্গহস্ত। এরও যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা অনেক শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সাথে ভালো ব্যবহার করি না, তাদের কথা শুনি না, তাদের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে চাই না, শ্রেণীকক্ষে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখি, ক্লাসের বাইরে কথা বলতে আসলে বিরক্ত হই, তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের চেষ্টায় সাথে থাকি না। শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসা কোনো সম্পর্কেই ওয়ান-ওয়ে রুট না। আমরা শিক্ষার্থীদের যা দিতে চাই না বা কম দিই, আমরা শিক্ষক বলেই শিক্ষার্থীরা আমাদের তা আনকন্ডিশনালি দিয়ে যাবে এই আশা করা নিতান্ত বোকামি। শিক্ষার্থীদের সাথে একটু আন্তরিক ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীরা সেই শিক্ষকের জন্য জীবনও দিতে পারে, অসীম শ্রদ্ধা করতে পারে। 

আমরা শিক্ষকরা যদি সামগ্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ আর আরো বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব না হই, নিজেদের সম্মানের জায়গাটা নিজেরা ধরে রাখতে না পারি, তাহলে সামনে আমাদের জন্য আরো কঠিন দিন অপেক্ষা করছে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স।