রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের উদ্যোগ

জনগণের হাতে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গত বছরের জুলাইয়ে ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এর ঘোষণা দেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি সেদিন বলেন, গত এক দশকের অধিক সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার হীনউদ্দেশ্যে অনেক অযৌক্তিক মৌলিক সাংবিধানিক সংশোধনী আনয়ন করেছে।

এরপর বিএনপির ওই ৩১ দফা নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুব কমই। সরকার পতনের আন্দোলনের ডামাডোলে চাপা পড়ে যায় ৩১ দফা। বুদ্ধিজীবী, কলাম লেখকরাও কেউ এ নিয়ে কথা বলেননি। যদিও বাইরের বিশ্বে, এমনকি ভারত-পাকিস্তানেও বুদ্ধিজীবী, কলাম লেখক, সমালোচকেরা তাদের দেশের সব দল নিয়েই কথা বলেন। ভালো বিষয় থাকলে প্রশংসা করেন। খারাপ কিছু থাকলে নিন্দা জানান। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ধারা দেখা যায় না। আওয়ামী লীগ নিয়ে অনেকে কথা বললেও, বিএনপির বিষয়ে চুপ থাকেন। এমনকি নিজের ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলার পরও বিএনপির কর্মসূচিকে তারা ভালো বলতে চান না। যেসব কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাইলফলক হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিএনপির ৩১ দফা নেই আলোচনায়।

তাদের এ কর্মসূচির কয়েকটি পয়েন্টের একটি হলো, ‌‘প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সহমত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক একটি রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। এ জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে।’

উন্নত বিশ্ব এই রেইনবো নেশনের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকে অনেক এগিয়ে আছে। পৃথিবীতে একই দেশের নাগরিকদের ভেতর বিদ্বেষ, বিভেদ খুব কমই পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বর্ণ ও ধর্মগত মিল থাকার পরও যে বিভাজন, তা অকল্পনীয়। বিএনপি তা থেকে বেরিয়ে আসার যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা আমলে না নিলে একই ভুলের বৃত্তে ঘুরপাক খেত হবে আমাদের। নাগরিক সমাজ যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য, দাবি, ঘোষণাপত্র বিষয়ে ওয়াকিবহাল না হয় এবং কথা না বলে, তাহলে আখেরে তাদেরই ক্ষতি।

বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার মধ্যে আরো রয়েছে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন করা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে। পর পর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।

বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে 'উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে।

এসব ঘোষণা অবশ্যই ইতিবাচক। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ‍খুবই উপযোগী এবং উপকারী। কিন্তু কোথাও তেমন আলাপ-আলোচনা হলো না এসব নিয়ে। উল্টো বিএনপি নেতারা আন্দোলন করতে গিয়ে ধর-পাকড়ের শিকার হন। তাদের বিপুলসংখ্যক কর্মীকে হত্যা করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে ৩১ দফা হারিয়ে যায়।

তবে চলতি মাসে এ ৩১ দফার এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বিএনপির উচিত বিষয়টিকে আবার সামনে নিয়ে আসা। তাদের ঘোষণাগুলো মানুষের মনের ভেতরে প্রবেশ করানো। এর কিছু উদ্যোগ অবশ্য বর্তমানে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মাঝে বিষয়টি ছড়িয়ে দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে এখন।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা। তারা এ নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। অন্যান্য বামপন্থী এবং সরকার বিরোধী আন্দোলনের যুক্ত গণতান্ত্রিক দলগুলোও বিভিন্ন ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির ৩১ দফার সঙ্গে যার গুণগত মিলও আছে। তারপরও সবাই চুপ। এত বড় একটা বিপর্যয়ের ভেতরে থেকেও যেন কারো হেলদোল নেই।

তবে বিএনপিকে তার এ ৩১ দফা নিয়ে নতুন করে প্রচার-প্রচারণা শুরু করতে হবে। জনগণের সামনে তাদের কর্মসূচিগুলো নিয়ে যেতে হব। তারা যে আশ্বাস দিতে চায় তা খোলাসা করতে হবে। বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে, জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন। আর তা এই ৩১ দফার প্রচারের মাধ্যমে সম্ভব।