ভারত কি শেখ হাসিনাকে চীনে যেতে মানা করেছিল?

১২ জুন জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তা প্রকল্পে চীনের ঋণ নেওয়ার জন্য চীন সরকারকে অনুরোধ জানাবে। কিন্তু ২১ ও ২২ জুন ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েই তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিলেন তিনি। জানা গিয়েছিল, তিস্তা প্রকল্পে অংশগ্রহণের আগ্রহ জানিয়েছে ভারত এবং আওয়ামী লীগ সরকার তাদের আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে। এর আগে ৮ মে ভারতের বিদেশ সচিব বিনয় মোহন খাত্রা দুই দিনের জরুরি সফরে ঢাকা এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন তিস্তা প্রকল্পে ভারত অংশীদার হতে চায়। কিন্তু বিনয় মোহনের সফরের পরও সরকার যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়নি, সেটা বোঝা যায় সংসদে শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে। কিন্তু ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে রেওয়াজ অনুসারে আয়োজিত  সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তিস্তা প্রকল্পে ভারত যুক্ত হলে তিস্তা নিয়ে সব সমস্যার সমাধান একেবারে হয়ে যাবে। ভারত এ বিষয়ে একটি কারিগরি টিম তৈরি করেছে, তারা বাংলাদেশে এসে দেখবে এবং তিস্তা প্রকল্প নিয়ে তাদের প্রস্তাব দেবে।

দৃশ্যত, শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলনে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে, ভারত ও চীন দুদেশই তিস্তা নিয়ে আগ্রহী। যাদের প্রস্তাব ভাল হবে তাদেরটাই তিনি গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ যাদের প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য উপকারী হবে, যারা সহজ শর্তে ঋণ দেবে তাদের সঙ্গেই তিনি কাজ করবেন। তাৎক্ষণিকভাবে এটাকে ভাল চাল মনে হলেও চীন সফর শেষ হওয়ার পর মনে করা হচ্ছে, তার এই চালে চীন ধরা দেয়নি। আগে ধারণা করা হয়েছিল, শেখ হাসিনার চীন সফরে তিস্তা প্রকল্প বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে চীন সফরে এ নিয়ে কোনো কথাই ওঠেনি, চুক্তি স্বাক্ষর তো দূরের কথা। বোঝা যাচ্ছে, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে চায় না। অর্থাৎ তিস্তা প্রকল্প আপাতত মাঠে মারা গেল। এ নিয়ে চীন-ভারতের টানাপোড়েন কাজে লাগিয়ে সুবিধা বাগানোর সুযোগও আর রইলো না।

চীন শুধু তিস্তা প্রকল্প নিয়ে নিরব থেকেছে তা-ই নয়, বহুল আলোচিত ইউয়ানে ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ঋণ নিয়েও কথা তোলেনি। বরং এক বিলিয়ন ইউয়ান ঋণ বরাদ্দ করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, চীন একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে না দিলেও কোনো ধরনের দরকষাকষিতে যায়নি। তারা উল্টো বড় চাল দিয়েছে। তাতে মনে হচ্ছে, এবার শেখ হাসিনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভারত না চীন কাকে তিনি কাছে চান।

কিন্তু শেখ হাসিনার সামনে ভারত ছেড়ে চীনকে নেওয়ার উপায় নেই। শুধু যে উপায় নেই তাই নয়, ভারতকে সামান্য পরিমান নাখোশ করার ক্ষমতাও তার নেই। ভারত সফর শেষে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান বিষয়ে যে ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন তা বাংলাদেশের একজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে নজিরবিহীন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সংবিধানের বয়ান পাশ কাটিয়ে তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তা সত্ত্বেও মহানুভবতা দেখিয়ে ভারতীয় বাহিনী শেখ সাহেবের কথায় বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়েছে। এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই।

অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনা কেন হঠাৎ এই বয়ান নিয়ে হাজির হলেন। রেল করিডোরসহ নানা চুক্তি নিয়ে ভারতের পক্ষে শেখ হাসিনা যে কথাগুলো বলেছেন তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তিনি যথেষ্ট অসহিষ্ণুতা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তাতে মনে হয়েছে ভারতের স্বার্থই তার কাছে মুখ্য।

ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি।

শেখ হাসিনার পর ৩ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফর নিয়ে, কোনো আপত্তি নেই ভারতের। দিল্লি সফরের সময়ই, এ বিষয়টি নরেন্দ্র মোদিকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। চীন সফরে, দেশের উন্নয়নই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে বলেও জানান হাছান মাহমুদ।’

এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভারত আমাদের রাজনৈতিক বন্ধু, চীন আমাদের উন্নয়নের বন্ধু।’

আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কথা থেকে স্পষ্ট, চীন সফরের আগে ভারত ও চীনের মধ্যে ব্যালান্স করতে সরকারকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে যেমন অন্যায়ভাবে ভারতের পক্ষে কথা বলেছেন, তেমনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকও যুক্তহীন কথা বলেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীন অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো বক্তব্য দিয়েছেন।

কেউ কেউ ধারণা করছেন, ভারত সফরের সময় ভারতীয় নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ সরকারকে এমন কোনো নির্দেশনা দিয়েছিল যা ম্যানেজ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ সহ শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে কোনো রীতিনীতির ধার না ধেরে ভারতের পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য দিতে হয়েছে।

কিন্তু ভারত কী চেয়েছিল?

তাদের চাওয়া অনুসারে রেল ট্রানজিট, স্যাটেলাইটে অংশীদারিত্ব, স্পর্শকাতর প্রতিরক্ষা বিষয়ে সহযোগিতা চুক্তিসহ অনেক কিছু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে ভারতের কোনো চাওয়াই অপূর্ণ রাখেনি। তিস্তা প্রকল্প এক ধাক্কায় চীনের বদলে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তাহলে ভারত কী চেয়েছিল যা ম্যানেজ করতে এভাবে কথা বলতে হলো?

কেউ কেউ মনে করছেন, শেখ হাসিনাকে চীন যেতে মানা করেছিল ভারত। তারা কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

প্রথমত, সেইন্ট মার্টিনের কাছে বার্মিজ বাহিনীর অবস্থান নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল সংসদে শেখ হাসিনার তিস্তা প্রকল্প বিষয়ক বক্তব্যের পর। এবং তখন শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি সফরে যাবেন কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরে নিশ্চিত হয়, চীনের আগে তিনি ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে যাবেন। তখন সেইন্ট মার্টিন থেকে বার্মিজ বাহিনী সরে যায়। এ থেকে কেউ কেউ ধারণা করছেন, আগে বার্মিজ সেনাবাহিনীকে দিয়ে চীন বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও এবার ভারত বার্মিজ বাহিনীকে দিয়ে চাপ দিয়েছে। আরাকান আর্মির প্রতি চীনের সমর্থনের কারণে বার্মিজ জান্তা ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভারত ও জান্তার মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে। এবার সেইন্ট মার্টিনে বার্মিজ যুদ্ধ জাহাজ এনে ভারত সরকারকে চাপ দিল।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি সকলে আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছেন, তা চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের সঙ্গে জড়িত। ভারতের চাপে সরকার বেনজীরের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিল। সংখ্যালঘুদের জমি দখল ও সংখ্যালঘু নারীদের চাপ প্রয়োগ করে সম্পর্কে জড়ানোর কারণে ভারত তার ওপর রুষ্ঠ ছিল। পেছনে আরও হয়তো কিছু কারণ ছিল। কিন্তু বেনজীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শুরু হতেই আজিজের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খবর চলে আসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কলকাতায় আনার হত্যাকাণ্ড। এর পর একের পর এক দুর্নীতিবাজদের খবর সামনে আসতে থাকে।

অনেকে ধারণা করছেন, সরকার স্বেচ্ছায় এগুলো করছে না। বেনজীর দিয়ে প্যান্ডোরার বাক্স খুললেও অনেকের ফাঁস হওয়া তথ্যের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু ব্যক্তির দুর্নীতি বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে চাপ দিয়েছে বলে মার্কিনপন্থীরা বলার চেষ্টা করেন। কর-সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে আইএমএফ আগ্রহ দেখাতে পারে। ভেতরের দ্বন্দ্বও প্রশাসনের অনেকের তথ্য প্রকাশ্যে আসতে সহযোগিতা করছে। কিন্তু মূল কাজটা করছে ভারত। তারা সরকারকে অস্থিতিশীল করে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে সম্ভবত। লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করেছে। পুলিশ-প্রশাসনে অস্থিরতা চলছে। কিন্তু সরকার বিষয়টি থামাতে পারছে না। চীনমুখি নীতি থেকে সরে না এলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে বলেও মনে হয় না।

তৃতীয় যে বিষয়টি সবার সামনে এসেছে তা হলো, জাতীয় পেনশন স্কিমে শিক্ষকদের যুক্ত না হতে চাওয়ার আন্দোলন। ঈদের আগে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করার রায় ঘোষণার পর ধারণা করা হয়েছিল, ঈদের পর এ নিয়ে জোরদার আন্দোলন হবে। কিন্তু এর মধ্যে শিক্ষকদের পেনশন স্কিমে ঢোকানো হলো। আন্দোলনে ডাবল ধামাকা তৈরি হলো। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রাস্তায়, শিক্ষার্থীরাও রাস্তায়। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুই আন্দোলনকে একই সূত্রে বেঁধে দেওয়ার পেছনে বিশেষ ষড়যন্ত্র আছে। এমনকি সরকারের নাজুক সময়ে হাইকোর্ট কেন কোটা পুনর্বহালের রায় দিল তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ নিয়ে বিচার বিভাগের নানা মন্তব্য থেকে ধারণা করা হচ্ছে, তারা চান আন্দোলন জোরদার হোক। বিশেষ করে, পুরো চীন সফরের সময় জুড়ে বিচার বিভাগ বিষয়টি নিয়ে যেভাবে মন্তব্য করেছে তা নিয়ে সরকারের ভেতরেই অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। চীন সফরের সময় সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করার জন্য কোটা বিরোধী আন্দোলনকে জিইয়ে রাখা হলো কি না তা নিয়ে ভাবছেন অনেকেই।

অন্যদিকে, মার্কিনীরা সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে তারা যেন মানবাধিকার লংঘন করে আন্দোলন দমন করার পথে না যায়। তাতে মার্কিন সরকারের ওপর মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপ তৈরি হবে। মার্কিন সরকার কথা বলতে বাধ্য হবে। মার্কিনীদের নিরব সমর্থনের স্বার্থে সরকার কঠোর অবস্থানে যেতে পারছে না।

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের ভেতরে ভারত যেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে তাতে পুলিশ, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, বিচারবিভাগ, মিডিয়া, নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সর্বত্র তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার নামেই ক্ষমতায় আছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে সরকার খুব ভাল করেই জানে, ভারতের স্বার্থের বাইরে একচুল সরলেই তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এ কারণেই চীন সফরের আগে নানা অনুরোধ-উপরোধ করে তারা ভারতকে ম্যানেজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারত চেয়েছিল, চীন সফর ব্যর্থ হয়েছে সেটি প্রকাশ্যে আনতে। আর সে কারণেই, প্রধানমন্ত্রীকে একদিন আগেই ফিরিয়ে আনা হলো।

এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ভারতের নিয়ন্ত্রণ আরো পাকাপাকি হলো। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রথম ৭ মাসেই এই অবস্থা। বাকী সময়ে কী ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।