কোটা: আদালতের ঘাড়ে সরকারের বন্দুক!

শাহবাগে কোটাবিরোধীদের অবস্থান। ছবি: নাজমুল ইসলাম

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বিষয়টি সমস্যা হিসেবে বেশ পুরনো । মাঝে এই সমস্যাটির এক ধরনের সমাধান হলেও ফের গুরুতর একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত ক’দিন ধরে কোটা বাতিলের ইস্যুতে রাজপথে ব্যাপক বিক্ষোভ করছেন চাকরিপ্রার্থী বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এ কথা প্রমাণিত সত্য যে, গত ক’বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বড় ও শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছাত্রশক্তি। সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বাতিলের আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় ছাত্রদের আন্দোলনে দিশেহারা হয়েছিল সরকার। এর সবগুলোতেই সরকার তার পেটোয়া পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করেছে, পাশাপাশি ছাত্রলীগকে মাঠে নামানো হয়েছিল হাতে লাঠি আর মাথায় হেলমেট পরিয়ে।

এবার কোটা বাতিল বা সংষ্কারের জন্য যে আন্দোলন চলছে তা অনেকটা হুট করেই সামনে চলে আসে। কেননা এটি একটি মিমাংসিত বিষয় ছিল। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এরপর ওই গ্রেডগুলোতে চাকরির নিয়োগ আর নিয়োগ প্রক্রিয়া হচ্ছিলো কোটা ছাড়াই। এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট পরিপত্র বাতিল করে রায় দেয় গত ৫ জুন। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করা হয়েছে। আপিল বিভাগে ১০ই জুন আপিল শুনানি শুরু হয়। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ে স্থিতিবস্থা জারি করে। এরপরে ৭ই আগস্ট পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেছে।

হাইকোর্টের রায়ের পর থেকেই শিক্ষার্থী, বিশেষ করে চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়। তারা প্রথমে সীমিত পরিসরে কর্মসূচি পালন করতে শুরু করেন। যতই দিন গড়াতে থাকে বাড়তে থাকে আন্দোলনের ব্যাপ্তি। মূলত: রাজধানী ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সরকারি দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান অবরোধ করতে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। পরে আন্দোলনকারীরা তাদের কর্মসূচির নাম দেয় ‘বাংলা ব্লকেড’। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সারা দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গন এখন অচল। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাদ দেয়ার দাবি নিয়ে কর্মবিরতি পালন করছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষের তালা খুলছে না।

দেশের অভিজ্ঞজনরা মনে করেন, কোটা নিয়ে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার দায়ভার সরকারের। কেন না ২০১৮ সালে পুরো কোটা বাতিল না করলে এ সংকট তৈরি হতো না, আর পুরো কোটা বাতিলের কোন দাবিও ছিল না আন্দোলনকারীদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটা ক্রোধান্ধ হয়ে কোটা বাতিল করেছিলেন। অথচ বিষয়টি নিয়ে সে সময় আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আর সময় দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ‘ওয়ান উইম্যান শো’ এর এই দেশে কে আর কি বলবে? সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কোটা বাতিল করে দেয়ার ঘোষণা দেন।

আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, কোটা ৫৬ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। এমনকি তাঁরা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সরকার প্রধান রেগেমেগে পুরোপুরি কোটাটা তুলে দেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। সে সময় কোটা পুরোপুরি বাতিল না করলে হয়তো এখনকারএই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত একটি সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তকে আবার আদালতের বিচার্য বিষয় বানানো হলো। এটাকে সরকারের কারসাজি মনে করছেন অনেকে। বিষয়টিকে এখন আদালতের বিষয় বানিয়ে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ সরকারের এখন আর কোন দায় নেই। মানুষকে কতটা বোকা ভাবে এরা!  আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করা আওয়ামী লীগের পুরণো অভ্যাস। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আইনের ওই অংশটুকুই পরিপালন  করে যেটুকু তাদের অনুকূলে যায়, আদালতের ওই অংশটুকুই তাদের কাছে নমস্য যে অংশটুকু তাদের সুবিধা দেয় বা যাতে তাদের সুবিধা হয়।

কোটার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সরকার তো কোটা বাতিলই করেছে। সরকারের বাতিল করা একটি বিষয় আদালতের রায়ে পূণর্বহাল হয়ে গেল, এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কি ছিল? সরকারের আইন শাখা কতটা সক্রিয় ছিল? নাকি হারার জন্যই এ খেলায় নেমেছিল সরকার। আওয়ামী লীগ নেতারা খুব গর্বের সাথে বলেন শেখ হাসিনা ক্ষমা করেন কিন্তু ভুলে যান না, কোটা সংষ্কারের দাবি মানতে তাকে বাধ্য করেছিলো দেশের ছাত্র ও যুব সমাজ। সেই বিষয়টি শেখ হাসিনা হয়তো ভুলে যাননি, তাই বিষয়টি আদালতে গেছে, এখন আদালত এর সুরাহা করবে! একেই বলে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করা। আওয়ামী লীগ যে কত বড় শিকারীদের দল তা বুঝতে এ প্রজন্মকে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।