৩১ দফা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে বার্তা দিচ্ছে
গত বছরের ১২ জুলাই, ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বিরোধী আন্দোলনে যে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আছি; আমরা আন্দোলনের রাজনৈতিক ভিত্তি হিসাবে ৩১ দফার একটা রূপরেখা প্রস্তাবনা জাতির সামনে হাজির করি। এই বছরের ১২ জুলাই আমাদের ৩১ দফা রূপরেখার ১ বছর পূর্তি হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতটা ছিল এরকম যে, আমরা বিভিন্ন মতাদর্শের, বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তার, বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার যে রাজনৈতিক দলগুলো; যারা এ দুঃশাসন বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি—আমাদের তো একটা সাধারণ রাজনৈতিক অবস্থান প্রয়োজন, প্রয়োজন ছিল আমাদের একটা রাজনৈতিক ভিত্তি প্রনয়ণ করা। আমরা প্রায় সাত-আট মাস একটানা নানা পর্বে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনার পর ৩১ দফা প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করি। ১২ জুলাই বিএনপি বিএনপির মতো করে ৩১ দফা হাজির করে। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের দিক থেকে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ৩১ দফা প্রস্তাবনা হাজির করি। তবে বিএনপির ৩১ দফার সাথে গণতন্ত্র মঞ্চের ৩১ দফার কিছু পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যটাই একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যাবে।
যুগপৎ আন্দোলনের ৩১ দফার ভিত্তি হিসাবে আমাদের মধ্যে গভীর এ উপলব্ধি কাজ করেছিল যে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের মধ্য দিয়ে আমরা গতানুগতিকভাবে শুধু একটা সরকার পরিবর্তন করেত চাইনি, শুধু দল বা মার্কা বদল করতে চাইনি। প্রথমত, যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা; শেখ হাসিনার মতো এরকম ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত্তি তৈরি করে; এরকম একটা জবাবদিহিহীন, দায়বদ্ধতাহীন, এ রকম একটা স্বেচ্ছাচারি শাসনের জন্ম দেয়—সেই ব্যবস্থার আমরা পরিপূর্ণ পরিবর্তন চেয়েছি। তার মানে গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটা পরিবর্তন, সাংবিধানিক কাঠামোর একটা পরিবর্তন; যে ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক এ শাসনকে চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত করে, তার পরিবর্তন করতে চেয়েছি। কারণ বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার উৎস কিন্তু বিদ্যমান সংবিধান, সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে আমরা পরিবর্তনের কথা বলেছি। অনেক সময় আমি মজা করে বলি, বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক সংবিধানে নারীকে পুরুষ আর পুরুষকে নারী ছাড়া সবকিছু করতে পারেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ দিয়ে দিয়েছে। সরাসরি জনগণের কাছে তার দায়বদ্ধতা, তার জবাবদিহির তেমন কোনো সুযোগ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকেও তার জনগণ যেভাবে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারে, ‘ইম্পিচ’ করতে পারে বাংলাদেশেরল সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে সেভাবে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ নেই। যে পর্যন্ত তার দলের এমপিরা তার ওপর আস্থা রাখেন, সে পর্যন্ত জনগণ যেটাই ভাবুক না কেন, তিনি স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা চালিয়ে যেতে পারেন।
৩১ দফার প্রেক্ষিতটা ছিল, একদিকে যেমন হাসিনার এ ফ্যাসিবাদকে বিদায় দেয়া, উচ্ছেদ করা; পাশাপাশি আগামী নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী গণতান্ত্রিক উত্তরণের ভেতর দিয়ে বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা-কাঠামো তার একটা আমূল পরিবর্তন সাধন করা; যাতে ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচিত সরকারও আর স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে না পারে। তার জন্য জবাবদিহিহীন একটা সীমাহীন ক্ষমতা যাতে কেউ ভোগ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। আর গুরুত্বপূর্ণ ছিল—রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ৩১ দফার এই বার্তা জনগণের কাছে সত্যি সত্যি আমরা দিতে চেয়েছি। আমরা নিশ্চয় কেবল গতানুগতিক ধারায় এ’র পরিবর্তে বি, বি’র পরিবর্তে সি—এ রকম কোনো সরকার দেখতে চাই না। সত্যি সত্যি আমরা জনকল্যাণের লক্ষ্যে গোটা ব্যবস্থার একটা গণতন্ত্রিক রূপান্তর, গণতান্ত্রিক সংস্কার, গণতান্ত্রিক পরিবর্তন করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে প্রশাসন, রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান গঠনের দিকে চাই। সেই জায়গা থেকে আমরা আলাপ-আলোচনা করে ৩১ দফা তৈরি করি। ৩১ দফার মধ্যে আবার একটা ১ দফা আছে। সেই ১ দফার মধ্যে স্বৈরতন্ত্রের উচ্ছেদ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অবাধ বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিকদের হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং নির্বাচনের পরে সংস্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে ।
৩১ দফা নিয়ে মানুষের কাছে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া আমরা পেয়েছি। মানুষের মধ্যে এক ধরনের জাগরণ দেখা গেছে। আমরা জনগণের কাছে যে বার্তাটা বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বিরোধী দল থেকে দিতে চেয়েছি—সেটা হচ্ছে এই যে, আমরা শুধুমাত্র গতানুগতিক পরিবর্তন নয়; রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, সাংবিধানিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকামী যে পরিবর্তন চাই—সেই লক্ষ্যে ৩১ দফাটা। ৩১ দফার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ক্ষমতার দম্ভে স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। লাগামটা এরকম যে—সেখানে সরকার, সরকার প্রধানের জবাবদিহির কথাটা পরিষ্কার করে আমরা নিয়ে আসছি। আধুনিক যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সাথে বিচার বিভাগ এবং আইন প্রণয়ন বিভাগের একটা যৌক্তিক ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক থাকে। বাংলাদেশে বাস্তবে দুটো ব্যবস্থাকেই নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে নিয়ে আসা হয়েছে। এটা পরিবর্তন করার প্রস্তাবনা ৩১ দফার মধ্যে আছে। আইন প্রণয়ন বিভাগের পাশাপাশি আবার বিচার বিভাগ সত্যি সত্যি যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করা দরকার। বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রও কীভাবে গণতান্ত্রিক করা যায় অর্থাৎ সরকার, সরকারি দলের ইচ্ছার ওপরই কেবল বিচারকরা নিয়োগ হবেন না; তাদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা দেখে গণতান্ত্রিকভাবে বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যাপারটা আমরা বলেছি। এ জন্য আমরা কমিশনের কথা বলেছি। সেখানে বিচারপতি নিয়োগ থেকে নিম্ন আদালতগুলোর যে পরিস্থিতি এটা নিয়ে আমাদের বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাবনা আছে। আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথোপযুক্ত ভাবে যাতে কাজ করতে পারে এরকম প্রস্তাবনা ৩১ দফার মধ্যে আছে।
আমরা জাতীয় সংসদের বাইরে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথাটাও ৩১ দফায় বলেছি। ভারতে যেমন রাজ্যসভা আছে লোকসভার বাইরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের ওপর সিনেট আছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এরকম আছে। কিন্তু দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট ‘আপার বডিটা’ কী রকম হবে ৩১ দফার মধ্যে পরিপূর্ণ সে ব্যাখ্যাটা নেই। হয়তো ভবিষ্যতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা করা যাবে।
এখন রাষ্ট্রপতির কেবল বাজেট পাস আর প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের বাইরে রাষ্ট্রের কয়েকটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছাড়া বিশেষ কোনো কাজ নেই। প্রধানমন্ত্রীর সাথে রাষ্ট্রপতিরও কিছু ক্ষমতা ভারসাম্যের বিষয় ৩১ দফার মধ্যে আছে। স্থানীয় সরকারকে কীভাবে প্রতিনিধিত্বশীল করা যায, দায়বদ্ধতা করা যায় সে প্রশ্নগুলো আমরা নিয়ে আসছি। আমরা কালা-কানুন সম্পর্কে কথা বলেছি— যে কালা-কানুন নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করে; যে কালা-কানুন সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সীমিত করে, সংকুচিত করে তা বাতিলের কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে শুরু করে সকল কালা-কানুনকে প্রত্যাহার করার কথা আমরা বলেছি; পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা বন্ধ করার কথা আমরা বলেছি। স্বাধীন কোনো জাতিরাষ্ট্রে কোনো নাগরিককে বিচারের বাইরে হত্যা করার সুযোগ নেই। যা খুশি তাই করে হত্যা করা—এই অনুমোদন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র দিতে পারে না—এই কথাগুলো আমরা বলেছি। সামগ্রিকভাবে ৩১ দফার মধ্যে অনেকগুলো ইতিবাচক প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কটাও কোন ভিত্তিতে হবে—জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। সে সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু প্রস্তাবনা আমাদের দফায় আছে।
আর ৩১ দফার দুর্বলতার কথা যদি বলি, প্রধান হলো অর্থনৈতিক এজেন্ডাগুলো। সাধারণ মানুষ যেখানে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। নতুন সরকার কি কি অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো করবে সে সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত নেই। জনগণের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশু করণীয় দিক- আমরা কি কি করবো, সেই ব্যাপারটাও রূপরেখা প্রস্তাবনার মধ্যে সবিস্তারে নেই।
আমরা ৩১ দফার মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে কিছু কথা বলেছি। যেমন ধরুন, ভারতের সাথে আমাদের বিরাট যে সংকট, যেখানে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার মতো—এই বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করে বিস্তারিত ৩১ দফার মধ্যে আমরা ব্যাখ্যা করিনি। ৩১ দফার দুর্বলতা হচ্ছে এসব বিষয়ে ব্যাপারে আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা দিতে পারিনি। হয়তো এগুলো ভবিষ্যতে আলাপ-আলোচনা হবে। গণতন্ত্র মঞ্চের কিছু বক্তব্য আছে। বিএনপি নির্বাচন পরবর্তী সরকারের কথা বলেছে। গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে আমরা এখনও এ ব্যপারে পরিষ্কার কিছু বলিনি।
বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার তেপান্ন-চুয়ান্ন বছর পার করছে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারের যে একটা দিশা ছিল; সেই দিশাটা বাংলাদেশে বর্তমানে নেই। এখন বাংলাদেশ তার উল্টো দিকে হাঁটছে। সাম্যের পরিবর্তে অসাম্য, গণতন্ত্রের পরিবর্তে ফ্যাসিবাদ, ন্যায়বিচারের পরিবর্তে এখন দুঃশাসন- এরকম একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাস্তবে সবকিছু ভেঙে পড়েছে। কোনো কিছুই এখানে ফাংশন করছে না। রাষ্ট্রপ্রশাসন পুরোপুরি একটা দলদাসে পরিণত হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাঁচ বছর পর নির্বাচনী তামাশার আয়োজন করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে বিরোধীদলের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তনের পথ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলো আরো গভীরে যেয়ে দেখা দরকার, বিশ্লেষণ দরকার। অনেক আইন পরিবর্তন করতে হবে। অনেক আইন তৈরিও করতে হবে। আমরা যে প্রস্তাবনা করেছি বাস্তবে আরো অনেক ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনার প্রয়োজন হবে।
৯০’র পর এই প্রথম আন্দোলনে এবার গোটা রাষ্ট্র, সরকার, সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রশ্নটাকে আন্দোলনের প্রধান ইস্যু হিসাবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে । তার মানে এটা আমাদের পাবলিক কমটিমেন্ট। আগামীতে গণতান্ত্রিক পরিবেশে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে এই সরকার আগের ধারায় আর চলবে না। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ৭ জানুয়ারির পর ৩১ দফার কিছু সংযুক্তি, পরিবর্ধন, পরিমার্জন প্রয়োজন হবে। দূরদর্শিতা নিয়ে এটা করতে পারলে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রুপান্তরের ৩১ দফা আরো গ্রহণযোগ্য ও আরও কার্যকরি হবে।