অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি কেন নয়!

এই বাংলাদেশে মাত্র সেদিন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল! এবং দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩৪ বছর আগে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিল।

প্রশ্ন হলো — সেই সময়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারা দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল কেন মাত্র ২০ বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে ২০০৯ সাল থেকে পরস্পর থেকে এতোটা দূরে সরে গেল? এই বিষয়টি বাংলাদেশের মানুষের প্রয়োজনেই খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ দেশ মানে তো পতাকা আর ভূখন্ড নয়। দেশের আসল সম্পদ তো মানুষ। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক ও সম্প্রীতি ছাড়া তো দেশ একটি জড় পদার্থ মাত্র!

কেউ কেউ বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি বিভেদ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। এই বিভেদ এখন প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে যথেষ্ট আলোচনাও হয়। অনেকেই বিষয়টি থেকে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। যেমন আমি নিজে কয়েক বছর আগে আমার কয়েকজন স্কুলবন্ধুকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। যাদের মধ্যে দু’জন বিএনপি নেতা, অন্য দু’জন আওয়ামী লীগের নেতা। দু’পক্ষই আমার দাওয়াতে আসার ব্যাপারে অন্যদের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের আপত্তিটা বেশি ছিল। তাদের যুক্তি ছিল ছোট শহর; এখানে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দাওয়াত খেতে এলে বিষয়টি নিয়ে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে। আমি তাদের যুক্তি প্রথমে মানতে না চাইলেও দীর্ঘ আলোচনার পর মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।

পরে ভেবে দেখেছি, আসলেই তো। এই সমাজ ও দেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এতটাই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে; এত বেশি স্বার্থ দিয়ে চালিত হচ্ছে — সমাজের সুবিধাবাদী মানুষ যারা মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে নিজেদের এগিয়ে নিতে চায় কিংবা অন্যকে হেনস্তা করতে চায়, তারা এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। অথচ যে কোনো রাষ্ট্র তথা সমাজের কল্যাণের প্রধানতম শর্ত হলো, অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্যকে ধারণ করা; বিভাজন নয়।

অনেকে অবশ্য এটাও মনে করেন যে, আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেও বিভেদ দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষত পদবঞ্চিত নেতারা দলের সুবিধাভোগীদের প্রতিপক্ষ মনে করেন। মাঝে মাঝে তাদের এই বিভেদ প্রকাশ্যে চলে আসে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এমন অভিযোগও রয়েছে যে, আওয়ামী লীগের সুবিধাপ্রাপ্তরা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার কৌশল হিসেবে নিজ দলের যোগ্য লোকদের দায়িত্ব দেওয়ার পরিবর্তে বিএনপির লোকদের জায়গা করে দিচ্ছেন; যাতে নিজ দলের প্রতিপক্ষ বা বিরোধীদের দমিয়ে রাখা যায়।

বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন না থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে একটি সমঝোতা আছে, যার ভিত্তি হলো আর্থিক ও রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন। এ ধরনের 'সমঝোতা' গত দেড় দশকে অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। তাই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরোধ দেখিয়ে একদল সুবিধা নিচ্ছে — যাদেরকে বলা যায় সুবিধাভোগী পক্ষ। তারা একথাও বলতে ভুলে যাচ্ছেন না যে, বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের মধ্যে দলীয় বিরোধ থাকলেও অনেকেই পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনির বিয়ে সূত্রে পরস্পরের আত্মীয়। আবার একই বাড়িতে ভাইবোন, চাচা-চাচি, মামা-মামি কিংবা অন্য কোনো সম্পর্কের মধ্যে এলাকার সব প্রধান দলের নেতাদের উপস্থিতি থাকে। রক্ত কিংবা সামাজিক সম্পর্কের আত্মীয়তার বাইরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের আশ্রয় দেওয়াটাও অন্যরা কর্তব্য মনে করেন।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকা সৎ ও নির্ভীক রাজনীতিকদের পাশাপাশি দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত পেশাজীবী সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়া দরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি দেশ গঠনের জন্য অপরিহার্য। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময় থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে ধরনের রাজনীতি প্রবর্তন ও লালন করে আসছে এবং ক্রমে যা সমাজের গভীরে বিস্তার লাভ করে দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙে পড়েছে; সেই রাজনীতি যে মোটেই কল্যাণকর নয় এটি এখন দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত।

এ অবস্থায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও চর্চাকে বিচার-বিশ্নেষণ করে কীভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা যায়, তা দুই দলের পক্ষ থেকেই ভেবে দেখার এখনই উপযুক্ত সময়। উভয় দলের দিক থেকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এ কথা জনগণের সামনে সুস্পষ্ট করতে হবে — তারা আর যাই করুক, দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণবিরোধী কোনো কাজে আর জড়াবে না। বরং ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মত ও পথকে ধারণ করা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের কল্যাণে যখনই দরকার হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। যেমনটি সবাই ১৯৭১ সালে করেছিল।

আমরা ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি। কিন্তু রাজনৈতিক সম্প্রীতির কথা কেন বলি না? কারণ একটি দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতাসহ সামগ্রিক অগ্রগতি শুধু সে দেশের বিভিন্ন ধর্ম, গোষ্ঠী, বিশ্বাসী, বর্ণ, জাতির নাগরিকের সহাবস্থানের ওপর নির্ভর করে না, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সহাবস্থানের উপরও নির্ভর করে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে 'সোনার বাংলা' হিসেবে দেখার যে আকাঙ্ক্ষা ৫৩ বছর আগে তৈরি হয়েছিল, সেটি যদি পেতে চাই তাহলে সব মত ও পথের মানুষের সহাবস্থানের বিকল্প নেই।

প্রশ্ন হলো- আমরা ৯০ শতাংশ মুসলমানকে ৮ শতাংশ হিন্দুর সঙ্গে মিলেমিশে থাকার কথা বলি। কিন্তু আমরা কেন মোট ভোটারের ৩৮ শতাংশ আওয়ামী লীগ ও ৩৪ শতাংশ বিএনপির ভোটারদের মিলেমিশে থাকার কথা কেন বলি না?

আমরা যাঁরা এই দেশের সাথে বেড়ে উঠেছি এবং ৫০-এর কোঠায়, তাঁরা একটা সুন্দর ও সৌহাদ্যপূর্ণ বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই। আমাদের এ চাওয়াটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়?

মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন