ফ্রাঙ্কো-বাঙালি বন্ধুত্বের সূচনাপর্ব, সময়কাল ১৯৭৬-১৯৮০

আজ ফ্রান্সের জাতীয় দিবস। ১৪ জুলাই দিনটি ফ্রান্সে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। এটি বাস্তিল দিবস হিসেবেও পরিচিত। ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৮৯ সালের এই দিনেই বাস্তিল দুর্গের পতন হয়েছিল। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে ফ্রান্স।

২০২৩ ও ২০২৪ সালে ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় অনেকগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। উভয় দেশের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পারস্পারিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক উন্নীত হয়েছে, যেটা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাকেও আনন্দিত করে।

সম্পাদিত চুক্তিসমূহ ও ফ্রান্স বাংলাদেশের পারস্পারিক কূটনৈতিক সম্পর্ক জানার আগ্রহ থেকে ফ্রান্স বাংলাদেশের অংশীদারিত্বের স্মৃতি সম্বলিত বিভিন্ন স্মারক,রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা, জার্নাল, ফ্রান্স বাংলাদেশের ৫০ বছরের মৈত্রীর ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ, বিভিন্ন সংস্থার ই-পোর্টাল, দূতাবাসের ওয়েবসাইট, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রকাশিত নিবন্ধ, আর্কাইভ, মুখবন্ধ বা আর্টিকেল পাঠ করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম উভয় রাষ্ট্রই কূটনৈতিক সম্পর্কের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের সঠিক তথ্য প্রচার করতে দ্বিধাভক্ত। সূচনা পর্বের প্রকৃত ইতিহাস সচেতনভাবে উভয় রাষ্ট্র পাশ কাটিয়ে গিয়েছে অথবা খণ্ডিত ইতিহাস উত্থাপন করেছে। 

ইতিহাস বিকৃতি, অসত্য ইতিহাস, অসহ্য ইতিহাস, স্বপ্নের ইতিহাস,অস্বস্তির ইতিহাস ইত্যাদি ঐতিহাসিক রোগে আমাদের রাষ্ট্র যে দীর্ঘদিন যাবৎ আক্রান্ত সে বিষয়ে আমি পূর্বেই অবগত ছিলাম, কিন্তু ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের পছন্দের প্রথম আশ্রয়াস্থল, শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী, বৈষম্যহীন নগরী, সভ্য রাষ্ট্রের রোল মডেল খ্যাত ফ্রান্স কখন কীভাবে যে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে সেটা আমাকে আশ্চার্য করেছে। ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’ সত্য বচনটি মনে মনে মিলিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছি। উভয় দেশের দেওয়া রাষ্ট্রীয় যৌথ বিবৃতিতে দেখলাম- স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ফ্রান্সের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে ঢাকায় বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ফ্রান্স সরকারের সাবেক সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাতের মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধুত্বের সূচনা হয়। পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য কোনো রাষ্ট্রীয় কূটনীতির উল্লেখ ছাড়াই ২০১১ সাল থেকে বন্ধুত্বের পারস্পারিক ইতিহাস লেখা হয়েছে। কোথাও আবার দেখলাম ১৯৯০ সাল থেকে ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল, আবার কোথাও ১৯৮১ সাল থেকে বন্ধুত্বের সূত্রপাতের কথা খণ্ডিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। খোদ ফ্রান্স দূতাবাসের নিজস্ব অনলাইন পোর্টালে ১৯৮০ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়টি একলাইনে উল্লেখ করলেও চুক্তির বিষয় উল্লেখিত হয়নি। ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় আর্কাইভে ১৯৮০ সালের পরবর্তী কর্মকাণ্ড থেকে সম্পর্কের ইতিহাস লেখা হয়েছে।

১৯৭৬-১৯৮১ সালে উভয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফর ও উন্নয়ন সহযোগিতায় দুই দেশের মধ্যকার বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার দালিলিক কোনো প্রমাণ বা স্মারক পরারাষ্ট্র দপ্তরের কোনো ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত নেই, অথবা থাকলেও তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্স-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা পর্বের ইতিহাস অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। 

১৯৬০-৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের স্থান নির্ধারিত হয়েছিল। প্রকল্পের অধীনে জমি ও প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইবাছাই সম্পন্ন করলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায় এবং প্রকল্প থেকে সরে আসে পূর্ব পাকিস্তান সরকার।

স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান প্রকল্পের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করেন এবং ১৯৭৪ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা চেয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আলোচনা শুরু করেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন অস্থিরতায় প্রকল্পটি আবারো স্থগিত হয়।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রকল্প প্রণয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আলোচনা শুরু করেন। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগী দেশসমূহের তালিকায় শীর্ষ স্থানে ছিল ফ্রান্স। বর্তমান সময়কালেও ফ্রান্স তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সে ৫৮টি নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর কার্যকর রয়েছে। ফ্রান্স নিজস্ব বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে।

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বলয়কে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমা ব্লকের পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ফ্রান্সের সহিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে ফ্রান্সের সাথে চুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যথেষ্ট কঠিন ছিল। 

১৯৭৬-১৯৭৭ সালে রূপপুর প্রকল্পের সম্ভাব্যতা ও কার্যকারিতা যাচাইবাছাই করার লক্ষ্যে ফরাসি প্রতিষ্ঠান সোফ্রাটমের (Sofratom) সহিত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই চুক্তি সম্পাদন করেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পের কার্যকারিতা ও সম্ভাব্যতার বাস্তবতা তুলে ধরে ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। ১৯৭৮ সালের ১ মে জিয়াউর রহমান সরকারের পরারাষ্ট্রমন্ত্রী শামসুল হক দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রাষ্ট্রীয় সফরে যান। তিনি প্রকল্পের বিভিন্ন কারিগরি দিকের ফলপ্রসু আলোচনা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ ১৯৭৯ সালের ৭ জুলাই দুই দিনের সফরে ফ্রান্সে যান এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় একাধিক সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং রাষ্ট্রপতির সফরসূচী নিশ্চিত করেন। ১৯৮০ সালের ২০ আগস্ট জিয়াউর রহমান যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার প্রাক্কালে ফ্রান্সে পূর্বনির্ধারিত সফরসূচী মোতাবেক যাত্রাবিরতি করেন এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে আমন্ত্রিত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভ্যালেরি গিসকার্ড ডিইস্টাইং কর্তৃক ইলিসি প্রাসাদে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। দুই রাষ্ট্রপতি সেখানে মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করেন এবং দিনের শেষে দুটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। একটি আর্থিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি, অন্যটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের সহযোগিতা সংক্রান্ত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ফ্রান্স সফর যে কতটা মর্যাদাপূর্ণভাবে বিবেচিত হয়েছিল তা ফ্রান্সের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন একীভূতকরণের অন্যতম প্রবক্তা, উন্নত দেশসমূহের অন্যতম জোট জি-৭ প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভ্যালরি গিসকার্ড উপস্থিত ফ্রান্স ও বাংলাদেশের কূটনীতিকদের উদেশ্যে দেওয়া রাষ্ট্রীয় বক্তব্যে তুলে ধরেছেন।

বক্তব্যের চুম্বক অংশের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

‘রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এই সফরটি হলো ফ্রাঙ্কো-বাঙালি বন্ধুত্বের সূচনাপর্ব।’

‘পরিশেষে উন্নয়ন, যেটি ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে স্বাধীনতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। জাতিসংঘের বর্তমান বিশেষ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক সংহতির ক্ষেত্রে দারিদ্রতম দেশগুলোর অগ্রগতির পথ খুলে দেওয়ার জন্য ফ্রান্সের প্রচেষ্টা ও সুপারিশ অব্যাহত থাকবে।’ তিনি জাতিসংঘের অধিবেশনে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জিয়াউর রহমানের দৃঢ় অবস্থানকে ‘বিজ্ঞ ও গঠনমূলক’ বলে প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘জোট নিরেপেক্ষ আন্দোলনের পাশাপাশি ইসলামী সন্মেলন বা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্কে জিয়াউর রহমানের গতিশীলতা ও সংযম বাঙালি কূটনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখছে। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি আপনার (জিয়াউর রহমান) গুণাবলীর প্রশংসা করি। মুসলিম সম্প্রদায় আপনাকে, কাসাব্লাঙ্কায়, মরক্কোর রাজা এবং গিনির রাষ্ট্রপতির সাথে জেরুজালেমের সমস্যা সম্পর্কে তাদের মতামত বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করার জন্য বেছে নিয়েছেন। তিনি দুই দেশের মধ্যকার নিয়মিত কূটনৈতিক যোগাযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি তার পরারাষ্ট্র বিষয়ক সেক্রেটারি অব স্টেট স্ট্রিনকে সে বছরের শরতে ঢাকা সফরে যেতে নির্দেশ দেন। তিনি জিয়াউর রহমানের সফরকে উভয় দেশের মধ্যে বোঝাপড়া, প্রতিশ্রুতিশীল সম্ভাবনা ও নব দুয়ার উন্মোচনের দৃঢ় প্রত্যয় বলে মনে করেন।

রাষ্ট্রপতির সাথে সফরসঙ্গী সকলের প্রতি তিনি সন্মান জ্ঞাপন করেন এবং বাংলাদেশি জনগণের প্রতি তিনি শুভকামনা জ্ঞাপন করেন।

গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ একজন লেখক ও রাজনীতিবিদ