সরকার কি পথ হারিয়েছে?

ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ব্যর্থ চীন সফর শেষে দেশে এসে চরম হতাশ ও হতোদ্যম ছিলেন শেখ হাসিনা। সাংবাদিক সম্মেলনে তাকে যথেষ্ট মলিন ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। বাংলাদেশের অনেকের মতো তিনিও হয়তো উপলদ্ধি করেছিলেন, চীন ও ভারতের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে সুবিধা বাগানোর দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। বাজেট সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ তিনি চীনের কাছে পাবেন না। চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে অন্য কোনো দিক থেকে বড় কোনো ঋণের প্রতিশ্রুতিও আপাতত নেই। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি, রিজার্ভ সংকট, লুটপাটের ফলে ঘনিয়ে আসা অর্থনেতিক সংকট অনেক আগে থেকেই তার কপালে ভাঁজ ফেলে রেখেছে। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। কিন্তু এই ব্যবস্থা আগাগোড়া দুর্নীতিতে নিমজ্জিত প্রশাসনে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করেছে। এতদিন যারা দুর্নীতির বিনিময়ে তাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে তারা এই ব্যবস্থায় বিক্ষুব্ধ হয়েছে।

শেখ হাসিনার  জন্য বাড়তি চাপ হিসেবে কাজ করেছে ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলন। শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দেশে তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ আর থাকবে না। তিনি যা খুশি তাই করতে পারবেন। সর্বাত্বক ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যে কেউ মুখ খুললে তা বন্ধ করার উপায় তিনি বের করে ফেলবেন। কিন্তু কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় তার চিন্তা বাড়ছিল।

চীন সফর শেষে দেশে আসার পর যে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন তাতে ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু সাংবাদিক শেখ হাসিনার হতাশাকে উস্কে দিয়ে তার মুখ দিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথা বলিয়ে নেন। চীন সফর বিষয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন সেখানে করা হয়নি। বরং চলমান আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করে করে শেখ হাসিনার মুখ থেকে উস্কানিমূলক কথাগুলো তারা বের করে নিতে পেরেছেন।

এটা সত্য, সরকারই কোটা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে চায়। প্রশাসনে-পুলিশে সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজেদের লোক ঢোকাতে হবে। এ জন্য কোটা পদ্ধতির বিকল্প নেই। এই পদ্ধতি বলবৎ থাকলে তারা ইচ্ছামতো পছন্দসই লোক দিয়ে আমলাতন্ত্র সাজাতে পারে। পাশাপাশি ভারতীয়রাও চায়, কোনো একটা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত নিজেদের লোক বসানোর ব্যবস্থা করতে। ২০১৮ সালের সফল ছাত্র আন্দোলনের পর কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলে সে কারণেই প্রশ্ন ফাঁস সহ বিভিন্ন দুই নম্বরী পথ বেছে নিতে হয়েছিল সরকারকে।

এবার ক্ষমতায় এসে কারণে হাইকোর্টকে দিয়ে তারা কোটা পুনর্বহালের রায় বের করে এনেছিল। অনেকে মনে করেন, এ রায়ের পেছনে সরকারের চাইতে ভারতীয়দের আগ্রহই বেশি ছিল। ভাবা হয়েছিল, এই রায়ের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি সরকার সামাল দিতে পারবে। রায়ের পর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে ঈদ উল আজহার ছুটির মধ্যে তা স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু ছাত্ররা ফিরে এসে আন্দোলন শুরু করলে সরকার কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়। তবু আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথ থেকে সহজে ফিরে আসতে চাইছিল না তারা। কিন্তু ২০১৮ সালের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা চাইছিল এই আন্দোলনে যাতে বিরোধী দলগুলো সম্পৃক্ত না হয়। আন্দোলন যাতে ছড়িয়ে না যায়। এ উদ্দেশ্য থেকে তারা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, বিশ্লেষক ও সাংবাদিকদের মধ্যে এ ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, এই আন্দোলন সরকারের উদ্যোগেই হচ্ছে। এই সাজানো আন্দোলন অচিরেই থেমে যাবে। সরকারের উদ্দেশ্য সফল করতে ২০১৮ সালের আন্দোলনকে ছোট করার নানা উদ্যোগের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বিরোধী বিশ্লেষকরা।

কিন্তু সরকার এক সঙ্গে অনেক ফ্রন্ট খুলে ফেলেছে একই সময়। ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেই শিক্ষকদের পেনশন স্কিম পরিবর্তনের উদ্যোগ সরকারের এমনই আরেক উদ্যোগ। এই উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দ্রুত উত্তপ্ত করে তুলেছে। আন্দোলন নিয়ে আদালতের নানা মন্তব্যও আন্দোলনকে জোরদার করেছে। এই আন্দোলনকে উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে প্রধান বিচারপতির নানা মন্তব্য। সরকারপন্থী অনেকে তার মধ্যে ইতিমধ্যে এসকে সিনহার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। বিচার বিভাগে ভারতীয় প্রভাব কতটা বেড়েছে তার উদাহরণ হিসেবে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক একটি পরামর্শের কথা সবাই বলছেন। সীমান্তের ১০ কিলোমিটার জায়গা ফাঁকা করার যে পরামর্শ একজন বিচারক দিয়েছেন তা যে ভারতের ইচ্ছার প্রতিফলন সেটা স্পষ্ট। এ রায় থেকে অনেকে ধারণা করছেন, ভারতের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আরো বড় ও বিপর্যয়কর রায় এই উচ্চ আদালত থেকে আসতে পারে। শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় তাকে চাপে রাখতে ভারতের পরামর্শ অনুসারে আদালত যে অপ্রত্যাশিত নানা মন্তব্য করেছে তাও অনেকে মনে করেন। প্রধান বিচারপতির রাজনৈতিক বক্তব্য ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে মাখামাখিকে ভাল চোখে দেখছেন না আওয়ামী লীগের লোকজনও। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে আন্দোলন একদিনেই নির্বাহী বিভাগের মধ্যেমে শেষ করা যেত আদালত সে আন্দোলন বাড়তে দিয়েছে।

আর এ সময়ে ছাত্ররাও ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে তারা সাজানো কোনো আন্দোলনে নামেনি। নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে আন্তরিকভাবে নেমেছে। এরমধ্যে ভারতপন্থী সাংবাদিকদের উস্কানিতে শেখ হাসিনার বেফাঁস মন্তব্য আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা ওই রাতেই ফুঁসে উঠেছে। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। বিষয়টা রাতারাতি আন্দোলন বনাম শেখ হাসিনা হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার ইগো এখানে জড়িত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনে এমন ঘটেনি। সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করলেও শেখ হাসিনা নিজেকে সব কিছুর উর্দ্ধে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু এবার তার মন্তব্যের কারণেই আগুন জ্বলেছে। শিক্ষার্থীদের দমন করতে তাদের ডেমোনাইজ করতে রাত থেকেই আওয়ামীপন্থীরা সদল বলে ঘৃণামূলক প্রচার শুরু করে। পরদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে আন্দোলন দমানোর নির্দেশ দেন। এর ফলে সারাদেশে আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক হামলা শুরু হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগ দেয় বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি ছাত্রলীগ-যুবলীগ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবোদের মুখে কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে যায় তারা। গত ১৫ বছরের ইতিহাসে এটাই সরকারি বাহিনীর প্রথম পরাজয়। আর এই পরাজয়ের কারণে ১৬ জুলাই পুলিশ ও দলীয় বাহিনীগুলোকে একত্রে নামানো হয়। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের মারমুখী অবস্থানের মধ্যেও ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকাসহ সারাদেশ অচল করে দেয়। পুলিশ নির্বিচার গুলি করে। সারাদেশে ছয় জন ছাত্র শহীন হন। রংপুরে শহীদ ছাত্রনেতা আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা ইতিমধ্যে সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সাহসী সাঈদ বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ যেভাবে নিরস্ত্র এই ছাত্রনেতার বুকে প্রকাশ্য দিবালোকে অল্প দূরত্ব থেকে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করেছে সেটি ভয়াবহ এক দৃশ্য। সেই ঘটনার ভিডিও দেখে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এই রংপুরে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা তো বটেই পুলিশের বড় কর্মকর্তারা এই ঘটনার জন্য জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি না হলে সেটি হবে বিস্ময়কর ঘটনা।

১৬ জুলাইয়ের ৬ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশের আপামর মানুষ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলেছে। এই প্রতিক্রিয়ায় বিপর্যস্ত সরকার ফেসবুক ব্যবহার সীমিত করে ফেলেছে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী ফেসবুক ইউটিউবকে হুমকি দিয়েছেন। ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত করা হয়েছে। সারাদেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউজিসি অবৈধপন্থায় পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে।

কারবালার স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র মহররমের ছুটির কারণে একদিন সময় পাবে সব পক্ষ। কিন্তু মহররমের আগের দিন যে কারবালা তৈরি হলো তা বাংলাদেশের সকল মানুষকে তীব্র ক্ষোভে জাগিয়ে তুলেছে।

পরিস্থিতি দেখে বিশ্লেষকরা বিস্মিত। আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এ ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই। যে পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত, ধৈর্য নিয়ে তারা এতকাল বিরোধীদের মোকাবেলা করে এসেছে তার ছাপ এবার দেখা যাচ্ছে না। কোনো এক অজানা কারণে অজানা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা যেন ভীষণ তাড়াহুড়া করছে। জেদ ও ইগোর বশবর্তী হয়ে কাজ করছে। একটা ফাঁপা ওভার কনফিডেন্স ভর করেছে সরকারের মধ্যে। শেখ হাসিনা ইগো থেকে অনেক কিছু করতে শুরু করেছেন।

কোনো কোনো বিশ্লেষক ধারণা করছেন, প্রথম সাত মাসেই ভারতের অতিরিক্ত চাপ ও প্রত্যাশা সামাল দিতে দিতে শেখ হাসিনা ক্লান্ত। তিনি বুঝতে পারছেন, ভারত এবার তাকে ক্ষমতায় বসানোর বিনিময়ে বড় কিছু না নিয়ে ছাড়বে না। আর তাদের প্রত্যাশা পূরণ না করলে ঘরে বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেবে না ভারত। তারা এবার সরাসরি বুঝিয়ে দিতে চায়, এখানে ড্রাইভিং সিটে শেখ হাসিনা নন, ভারতই আছে।

চারদিক দিয়ে সরকার বেশ চাপে পড়েছে। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ের ঘটনাবলী বলছে, সরকার নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে অনেকটাই।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সহপাঠীর লাশের সঙ্গে বেঈমানী করে পিছিয়ে যাবে না। তারা এরই মধ্যে নিজেদের সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছে। সাহস ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট দেখিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকলে এই আন্দোলনই সরকারকে চূড়ান্ত বিপদে ফেলবে। এবং এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সরকার গোঁ ধরেই বসে থাকবে।