শিশুদের রক্তেভেজা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান

স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে গেলে বুলেট হয় তার অনিবার্য়্ পরিণতি।  এটা জেনে বুঝে শহীদ আবু সাঈদ, আসিফ, শাকিল, ফারুক, ওয়াসিম, শাহজাহান, ফয়সাল , সবুজ, মুগ্ধ, নাজমুল, তামিম, ইয়ামিন, ইমন মিয়া, দীপ্ত দে, রুদ্র সেন, ইমরান, সিয়াম, ইসমাঈল, জিল্লুর রহমান, দুলাল মাতব্বর, শান্ত রাব্বি, ওদুদ, পাভেলসহ শত শত নাম আমাদের সামনে। এর বাইরে আরও অনেককে গুম করা হয়েছে। সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়েরের শেয়ারকৃত ভিডিও বলছে রায়ের বাজার কবরস্থানের গণকবরের কথা। সেখানে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ রকম সংখ্যায় বেড়ে গিয়েছে বেওয়ারিশ লাফ দাফন। আরও কত শহীদের লাশ গুম করা হয়েছে কে জানে? 

সরকারের মদদপুষ্ট একটি দৈনিকের শিরোনাম `গুলি খেয়ে কাতরাতে কাতরাতে রাস্তাতেই মারা যায় শিশু সাদ, উদ্ধারে আসেনি পুলিশও’ । সেখানে বাস্তবতা কত ভয়াবহ একবার চিন্তা করুন। আহাদ, রিয়া, সামির, হোসাইন, মোবারক, তাহমিদ, ইফাত ও নাঈমা নামের ফুলের মতো শিশুগুলোকেও রেহাই দেয়নি হায়েনাদের বুলেট। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে কয়েক দিনের সংঘর্ষে অন্তত ৯ শিশু গুলিতে নিহত হয়েছে। তাদের বয়স ৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই তারা গুলিবিদ্ধ হয়। নিহত চারজন মারা গেছে নিজ বাড়িতেই। চারজন গুলিবিদ্ধ হয় সড়কে। সব ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গেছে এই শিশুদের। এখনও চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ এমন কিছু শিশু।’

সরকারের অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিপ্লবী হিসেবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ১৮ বছরের কম বয়সী অনেকেই। তাদের র কয়েকজনকে সরাসরি আন্দোলনের মা{ঠে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার তথ্য ইতোমধ্যেই সবাই জানেন। ঘৃণ্য স্বৈরাচারকে প্রশ্ন করে লাভ নাই। তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন ১৬ বছরের দুরন্ত কিশোর  ইফাতের অপরাধ কী? সে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। হায়েনার দল ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে তাকে গুলি করে হত্যা করে। 

হিংস্রতার শেষ সীমায় দলদাস পুলিশদের কয়েকজন মিলে তাকে হাসপাতাল থেকে আহত অবস্থায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। তারপর তাকে সরাসরি বুকের বাঁ পাশে গুলি করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন। সরকারের মদদপুষ্ট একটি দৈনিকই সাহস করে এই সংবাদ ছেপেছে। ইফাত ছিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার মা কামরুন নাহার সাংবাদিকদের আরও বলেছেন তাঁর ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। সে রাস্তায় পড়ে থাকা আহত একজনকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। এই অপরাধে হিংস্র পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে সোজা সাপ্টা তার বুকে গুলি করে হত্যা করেছে। 

মা-বাবার কোলে থাকা অবস্থায় পুলিশ গুলি করে মেরেছে চার বছরের আবদুল আহাদকে। তার ভয়াবহ এই মৃত্যু পাষাণকে টলিয়ে দিলেও কাঁদাতে পারেনি স্বৈরাচারকে। পত্রিকা বলছে ‘ যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় ১১ তলা একটি বাড়ির আট তলার ভাড়া বাসায় থাকে তার পরিবার। ১৯ জুলাই বিকেলে পরিবারের সবাই বাসায় ছিলেন। সে সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ চলছিল। কী হচ্ছে দেখতে আর সবার মতো উৎসুক হয়ে ছোট্ট আহাদও বারান্দায় গিয়েছিল। এক পাশে ছিল বাবা, অন্য পাশে মা। হঠাৎ ঘাতক বুলেট তার ডান চোখে লাগলে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে শিশুটি। তারপর রক্তে ভেজা সন্তানকে বুকে নিয়ে সংঘর্ষের মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বাবা আবুল হাসান। শিশুটিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে  লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।  ২০ জুলাই রাতে আহাদকে মৃত ঘোষণা করা হয়’।

শিশুটির বাবা আবুল হাসান পত্রিকাগুলোকে বলেছেন ‘সবকিছু যেন চোখের পলকে ঘটে গেল। আমার আদরের ছোট ছেলেকে হারালাম। এ নিয়ে আর কী বলবো!’

বাবার কোলও নিরাপদ থাকেনি  নারায়ণগঞ্জের ছোট্ট শিশু রিয়া গোপের জন্য। তার বয়স হয়েছিল সবে ৬ বছর। স্কুলে যেতে শুরু করেছিল। পত্রিকার ভাষ্যে  ‘পুতুলের মতো মেয়েটি ২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় বাড়ির ছাদে খেলছিল। গোলাগুলি শুরু হলে বাবা তাকে কোলে নেন। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে রিয়ার মাথায়। ওই দিনই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৫ জুলাই নিভে যায় রিয়ার জীবনপ্রদীপ। সন্তান হারানোর হাহাকার বুকে নিয়ে রিয়ার বাবা দীপক কুমার গোপ বলেন, পরিবারের অন্যদের সঙ্গে মেয়েটা চার তলা বাড়ির ছাদে গিয়েছিল। তাতেই চলে গেল জীবনটা। এই শোক কী করে সইব?’

অনেকের ঘরের মধ্যে এসে যমদূতের মতো বুলেট হানা দেয়। ঠিক তেমনি মুহুর্তে টিয়ার শেলের ধোঁয়া ঘরে আসা ঠেকাতে ১১ বছরের সাফকাত সামির জানালা বন্ধ করতে গিয়েছিল। তখন তাকে লক্ষ করে গুলি করে পুলিশ। ওরা এভাবে গুলি করে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। ঠিক যেভাবে মোবাইলে ভিডিও করতে দেখে এক নারীকে গুলি করেছিল ঢাকায়। পুলিশের ছোঁড়া গুলি সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন গুলি লাগে একই ঘরে থাকা তার চাচা ১৭ বছরের মশিউর রহমানের কাঁধেও। তবে সে কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যায়। অনেকে দাবি করেছেন তার চাচাকে গুলি করতে মারতে চেয়েছিল পুলিশ আর সেই গুলি ফসকে লাগে শিশুটির চোখে। ওদিকে মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত সামির। তার পরিবার থাকে রাজধানীর মিরপুরে কাফরুল থানা-সংলগ্ন বাড়িতে। ১৯ জুলাই ওই এলাকায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর হিংস্রতা নিয়ে চড়াও হয় পুলিশ। তারা হায়েনার উন্মত্ততা নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছিল। তাদের খুনের নেশায় অনেক প্রাণ গিয়েছে। ঠিক তার মধ্যে একটি বুলেটে  ঘরের মধ্যেই প্রাণ যায় সামিরের। 

২০ জুলাই পড়ন্ত বিকেলে মা মালেকা বেগম শিশু হোসাইনকে ভাত খেয়ে ঘরে থাকতে বলছিলেন। কিন্ত পিচ্চিটা বের হয়ে গিয়েছিল। তারপর রাত দুইটায় তার মা বাবা তাকে আবিষ্কার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। আরও শতশত লাশের মধ্যে রক্তে মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে তাদের ছেলেও। শিশুটার অনেকগুলা গুলির ক্ষত। অথচ মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে শিশুটা বলেছিল ‘মা, আমি ছোট্ট। আমারে কে গুলি করবে?’ অবুঝ শিশু তো আর জানতো না স্বৈরাচারের রক্তক্ষুধা ড্রাকুলার থেকেও বেশি। 

পাঁচ ভাইবোনের সবার ছোট মোবারক দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া করতে পারেনি। মা-বাবার সঙ্গে থেকে গরুর খামার দেখাশোনা করত। পুলিশের রক্তক্ষুধায় এলোপাতাড়ি গুলি হয়ে গিয়েছে অনেকের নিয়তি তাই আন্দোলন দেখতে গিয়ে আর ঘরে ফেরেনি  ১৩ বছরের দুরন্ত কিশোর মোবারক হোসেন। সে ১৯ জুলাই অন্য অনেকের মতো রাজধানীর কাঁঠালবাগান ঢাল এলাকার বাসা থেকে অদূরে কারওয়ান বাজার মোড়ে গিয়েছিল আন্দোলন দেখতে। সেই দিন বিকেল ৫টার দিকে তাকেও সরাসরি মাথায় গুলি করেছে পুলিশ।  তার মা ফরিদা বেগম বিলাপ করতে করতে দৈনিক পত্রিকাকে বলেছেন  ‘খ্যালতে যাওয়ার সময় না হয় আন্দোলন দ্যাখতে গ্যাছেই। আমার পুলারে গুলি কইরা ক্যান মারছে? মিছিল দেখতে গ্যাছে– অয় যদি অপরাধ কইরা থাহে, এক-দুইডা থাপ্পড় দিয়া খেদায় দিত। মাথার মধ্যে গুলি করল ক্যান?’

পুলিশ-বিডিজিবির ভয়াবহ তাণ্ডবে ছুঁড়তে থাকা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল তাহমিদের বুক। গত ১৮ জুলাই নরসিংদী শহরে আন্দোলনকারীদের ওপর হায়েনার উন্মত্ত্তা  নিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকা পুলিশের একটি দল। তাদের গুলিতে আরও অনেকের সঙ্গে শহীদ হয় ১৪ বছরের কিশোর তাহমিদ ভূঁইয়া। সে পড়ত নাছিমা কাদির মোল্লা হাই স্কুল অ্যান্ড হোমসের (এনকেএম) নবম শ্রেণিতে।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা জানাচ্ছে ওই দিন বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নরসিংদীর জেলখানা মোড় এলাকায় শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে জড়ো হয়েছিল আন্দোলনকারীরা। তাহমিদ সেখানে পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিল তার সহপাঠীদের সঙ্গে। পরে পুলিশের ছোঁড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে তার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত আন্দোলনকারীরা পরে তাহমিদের লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে পরে মহাসড়কে যায়। তারা এই শিশুটিকে কেনো হত্যা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। মিছিল করে আন্দোলনকারীরা একটু অগ্রসর হলে সেখানেও পুলিশ উন্মাদের মতো গুলি করতে থাকে। পরে দেখা গিয়েছে মৃত্যুর পরেও ভয়াবহরূপে আবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তাহমিদ।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাঈমার বয়স মাত্র ১৬। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা  নাইমার দিকেও ঘাতক পুলিশের বুলেট ধেয়ে আসবে এটা কেউ কল্পনা করেনি। ১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশ গুলি করে খুন করেছে নাঈমাকেও। চাঁদপুরের মতলব উত্তরের আমুয়াখান্দা উত্তরপাড়া থেকে আসা নাঈমাদের বাসার সামনের সড়কে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি ছুঁড়তে থাকে পুলিশ। গুলির প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। পরিস্থিতি দেখতে সে গিয়ে দাঁড়ায় তাদের চার তলা ভবনের বারান্দায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটির মাথায় গুলি লাগে। তারপর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ডহীন উপাচার্য় নুরুল ও প্রক্টর কবীবের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হয় পুলিশ। তাদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে ২০ জুলাই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সাভার। বিকেলের দিকে সাভারে আন্দোলনকারীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। শাহীনবাগ এলাকায় বাড়ির পাশের চাপাইন সড়কে ধোঁয়া দেখে কৌতূহলবশত সড়কের নিউমার্কেটের পাশে যায় ১৪ বছরের সাদ মাহমুদ। সেখানেই তার শরীরে গুলি লাগে। স্থানীয়রা শিশুটিকে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

ইন্টারনেট বন্ধ থাকা, ফেসবুক ও ইউটিউবে মুক্ত সংবাদের প্রবাহে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি সরকারি গণমাধ্যমের নির্লজ্জ নীরবতায় গুম করা হয়েছে এমনি শতশত নৃসংশতার ঘটনা। তবুও ছাত্রজনতার বিপ্লবী প্রতিরোধে সফল হয়েছে ২৪ এর গণ অভ্যুত্থান। কিন্ত কেড়ে নিয়েছে অগণিত তাজা প্রাণ। সেখানে অবুঝ শিশুদের সংখ্যাটা এতো বড় হবে এটা খোদ সরকারের মধ্যে থাকা অনেক বিবেকবান ব্যক্তিও মেনে নিতে পারছেন না। শিশু হত্যার বিরুদ্ধে স্বোচ্চার এখন পুরো দেশ ও জাতি। প্রবাসীরাও ক্ষিপ্ত হয়ে শুরু করেছেন রেমিট্যান্স শাটডাউন। তাঁরা যেভাবেই হোক এই শিশু কিশোরদের হত্যার বিচার চান। তাঁরা প্রতিহত করতে চান সেই ঘৃন্য স্বৈরাচারকে যে স্বৈরাচারের হাতে আমার আপনার সন্তানের রক্ত, শিশু কিশোরদের রক্ত মেখে ক্লেদাক্ত।