হাসিনা এখন কর্তৃত্ববাদের প্রতীক: ফ্রান্সের পত্রিকায় সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের ছিয়াত্তর বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ‘এখন কর্তৃত্ববাদ (অথরিটারিয়ানিজম), স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার’ কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন বলে এক সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছে ফ্রান্সের প্রভাবশালী ‘ল্য মোঁদ’ পত্রিকা।

সম্প্রতি শেখ হাসিনার শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে দুই সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলন কাঁপন ধরিয়েছে দেশটিতে, তার প্রভাব পরতে শুরু করেছে অর্থনীতিতে।

সোমবার ফ্রান্সের প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, আন্দোলনের তেজ কমে আসলেও শনিবার হাসপাতাল থেকে আন্দোলনের নেতাদের অপহরণ করা হলে আবারো মাঠে নামার হুশিয়ারি দেয় ছাত্ররা। আহত ছাত্রদের মুক্তি না দেয়ায় আন্দোলন অব্যহত আছে।

ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষে যে আন্দোলন এখন চলছে সেটা শুরু হয়েছিলো সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে। এখন পর্যন্ত ২০০ জনের মুত্যুর খবর এলেও সংখ্যাটা অনেক বেশি। আহত হাজার হাজার মানুষ। বিক্ষোভকারীর পাশাপাশি (কর্তৃত্ববাদী) সরকারের সমালোচকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আন্দোলনের চাপে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ উত্তরাধিকারদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষিত পদের অনুপাত ৩০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার পর থেকে দেশটি পুর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিলো। উনিশশো একাত্তর সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয় এর পুর্বাঞ্চল।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য ও অনুসারীদের সুবিধা দেয়ার জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কোটা ব্যবহার হয়ে করে আসছেন পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা। তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।

দেড় দশক ধরে ক্ষমতা আকড়ে থাকা শেখ হাসিনার জন্য ছাত্র আন্দোলনে ‘স্বৈরাচারের পতন হোক’ শ্লোগান শোনার বিষয়টি কল্পনাতীত ছিলো। ছিয়াত্তর বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ‘এখন কর্তৃত্ববাদ (অথরিটারিয়াজম), স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার’ কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। হাসিনা এমন একটি ব্যবস্থার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছেন, যা এখন কেবল ‘নামেই গণতান্ত্রিক’।

বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রকে নিজের কল্পনামাফিক শাসন ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন হাসিনা। যাকে  ‘আয়রন উইম্যান’ বলা যায়। বাংলাদেশের শাসন ও ক্ষমতাকে তিনি ‘রাজ’ উত্তারাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছেন।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে কর্তৃত্ববাদ শাসন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রন করছেন। যেখানে ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ ( সাংবিধানিক সরকারের ভারসম্য নীতি) বলে কিছু নেই। দেশটির সবচেয়ে বড় বিরোধী দল (বিএনপি) গত জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন বর্জন করলে টানা চতুর্থবারের মত (বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে) ক্ষমতায় আসেন হাসিনা।

গত এক দশকে দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও হাসিনা এখন তরুণদের কাছে ‘হতাশার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে বিবেচিত। দেশটির তরুন সমাজ (২৪ বছর পর্যন্ত) জনগোষ্ঠির ৪০ শতাংশ বেকার। তাদের সরকারি চাকরিতে ঢোকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে গত শতাব্দীর মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকাররা। দেশটি সুপ্রিম কোর্টের রায় ছাত্রদের ক্ষোভের অবসান ঘটাতে যথেষ্ট ছিল না।

ইন্টারনেট চালুর মাধ্যমে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। কিছু কিছু শহরের কারফিউ তুলে দেয়া হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। তার পরেও ছাত্র আন্দোলনকারিরা বাংলাদেশের ‘ঘৃণিত’ নেত্রীর পদত্যাগ দাবি করছে। শেখ হাসিনা দেড় দশক ধরে ক্ষমতা ধরে রাখার সময়ে এতোটা চ্যালেঞ্জের মুখোমূখী হননি আগে। তার স্বৈরাচারি মনোভাব দেশটিতে রাজনৈতিক সহিংসতা উস্কে দিচ্ছে। প্রায় ১৭ কোটির বেশি মানুষের দেশটি এখন ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার আকাংখায় আছে।

একজন সেক্যুলার মুসলিম হিসেবে শেখ হাসিনা যে রাজনৈতিক আন্দোলনকে ‘হত্যাকান্ডের’ উপলক্ষ্য বানিয়েছেন এর সুযোগে দেশটিতে ইসলামপন্থীরা সুফল পেতে পারে বলে আশংকা করছে ‘ল্য মোঁদ’ পত্রিকা।