শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেই বিদায় নেবে সরকার

রাজউক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা স্কুল ড্রেস পরে উত্তরার রাজপথে যখন বিক্ষোভ মিছিল করছিল তখন আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় শ্রাবণের জানান দিচ্ছিল। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে যাদের যুব তবু হয়ে যাওয়ার কথা তাদের চোখে মুখে দেখলাম আগুনের স্ফুলিঙ্গ। মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে ধরে স্লোগান দিচ্ছে, "আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।"খুন হয়েছে আমার ভাই খুনি তোদের রক্ষা নাই"। একই সময়ে বাড্ডা- রামপুরা রাস্তায় ব্রাক ইউনিভার্সিটি এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মিছিল চোখে পড়ল। চোখে পড়ল সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল। আমরা যাদের ফার্মের মুরগি মনে করি, যারা মোবাইল ছাড়া কিছুই বোঝেনা, রাত দিন ঘরের কোণে বসে থাকে-তাদের এই রক্তঝরা মিছিল দেখে নিজেকে আর  ঘরে আটকে রাখতে পারছিলাম না। মনে হল এরাই তো আমাদের পথ-প্রদর্শক।তাদের মিছিল কাছ থেকে দেখার জন্য গ্যাভাডিনের প্যান্ট এবং লাল টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে পায়ে কেডস  পরে বাসার নিচে নেমে পড়লাম। কিন্তু শ্রাবণের বৃষ্টিধারার কাছে পরাজিত হয়ে আবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে লাইভ প্রোগ্রাম গুলো দেখার চেষ্টা করলাম। 'মার্চ ফর জাস্টিস' সম্বলিত ব্যানার নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বন্ধু হারা, সাথী হারা, ভাই হারা বেদনা নিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। এ কোন তরুণদের দেখলাম? ব্রাক ইউনিভার্সিটির মেয়ের কণ্ঠ থেকে আগুন ঝরতে দেখলাম। অনলবর্ষি বক্তার মত বলে চলেছে "আমাদের ২৬৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না। কিন্তু কাদের কাছে বিচার চাইবো, খুনিদের কাছে? ৯ দফা দাবি এখন আমাদের প্রাণের দাবি। যাদের গন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।"
 
যাদের চোখে মুখে এত তেজ কন্ঠে যাদের এত দৃঢ়তা তাদের কি জোর করে রাস্তায় নামানো যায়?মনে প্রশ্ন জাগলো - এদের মিছিলে কি তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে? রাজউকের শিক্ষার্থীদের যে অগ্নি মূর্তি দেখলাম সেটা কি কোনো তৃতীয় পক্ষ তাদের শিখিয়ে দিয়েছে?
 
তৃতীয় পক্ষকে কেন এত ভয় পাচ্ছে সরকার? তাদের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী নেতা পাতিনেতা এখন তৃতীয় পক্ষের ভয়ে অস্থির। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে বলে পাড়া মহল্লা কাঁপিয়ে তুলছেন তারা। কিন্তু আজ শুক্রবার ঢাকা সহ সারাদেশে সারা দেশে যতগুলো মিছিলের ছবি আমি দেখলাম সেখানে ব্যতিক্রম মাত্র তিনটি যার একটি হল বাংলা মোটরে লেখক সমাজ, দ্বিতীয়টি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নাগরিক সমাজ  তৃতীয়টি দেখলাম শহীদ মিনারে। সেখানে প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসকরা এবং বিকেল নাগাদ সমাবেশ করেছে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। বলা যায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। সাংবাদিকরা বলছিলেন দল-মত নির্বিশেষে সবাই এসেছে। তারা সবাই অভিভাবক, সন্তান হত্যার বিচার চান তারা। খুলনার জিরো পয়েন্টে বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা সকাল থেকেই অবস্থান নিয়ে শ্লোগানের স্লোগানে মুখরিত করে রাখে। কিন্তু বিকেল নাগাদ পুলিশ বিজিবি আনসার মিলে তাদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশের গুলিতে আহত অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তবে নিহতের তেমন কোন খবর এখনো পাওয়া যায়নি। সিলেটে আরো ভয়াবহ অবস্থা। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে নগরীর বিভিন্ন শহর প্রদক্ষিণ করতে গেলে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়। সেখানেও বহু শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। এর বাইরের রাজশাহী রংপুর চট্টগ্রাম বরিশাল বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সমস্ত মিছিলের দৃশ্য চোখে পড়েছে । সারাদেশেই প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করেই এ সমস্ত বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। একমাত্র জ্ঞান পাপী ছাড়া কিম্বা মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউ বলতে পারবে না মনের তাগিদ ছাড়া অন্তরের অনুভূতি ছাড়া কাউকে এমন মিছিলে সমবেত করা যায়।এটা দেখার পরও ওবায়দুল কাদের বললেন, "অশুভশক্তি আন্দোলনে ভর করেছে।"কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু থেকে এই ওবায়দুল কাদের বারবার উল্টোপাল্টা বক্তব্য দিয়ে নিজের নেতাকর্মীদের কাছেই ভুয়া প্রমাণিত হয়েছেন। এই আন্দোলন মোকাবেলার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে হুংকার দেওয়ার সাথে সাথে অস্ত্রপাতি নিয়ে পেটোয়া বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। নির্মমভাবে প্রহার করে ছাত্রীদের। তখনই মূল প্রতিরোধ শুরু হয় ক্যাম্পাসের ভেতর থেকেই আর তখনই ছাত্রলীগের পান্ডারা লেজ গুটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। শুধুমাত্র শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, হাসান মাহমুদ এবং নব্য আওয়ামী লীগের মোঃ আলী আরাফাত বক্তব্যের কারণে দুই শতাধিক দুই শতাধিক মতান্তরে পাঁচ শতাধিক নিরীহ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে কয়েক হাজার। 
 
শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং তার কান্না দেখে শিক্ষার্থীরা বলতে শুরু করেছে এটা তার একটা ভন্ডামী অভিনয় এবং প্রতারণা। তারা বলছে যে শেখ হাসিনার নির্দেশে আজকে তাদের ভাইদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তার হাত সেই হাতেই আবার তিনি জড়িয়ে ধরেন নিহতের স্বজনদের। আর কান্নাকাটি করে বলেন স্বজন হারানোর বেদনা তার চেয়ে আর কেউ বোঝেনা। তারা বলছে বর্তমানে শত শত শিক্ষার্থী নিহত হল তার নির্দেশে সে ব্যাপারে কোন বক্তব্য না দিয়ে তাদের ব্যাপারে শো প্রকাশ না করে তিনি ফিরে যান পঞ্চাশ বছর আগের কাহিনীতে। 
 
এবারের কোটা আন্দোলনে বাংলাদেশ সকল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছে। এটাকে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সাথে একটু মিলিয়ে দেখুন। তখনো পূর্ব বাংলার সমস্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিল। প্রতিপক্ষ ছিল আইয়ুব খান। সেই সময়   পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছিল আহাদসহ ৪ জন। তাতেই আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল।আর এবার একইভাবে সারা দেশের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সব মাঠে নেমেছে-প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ২৬৬ জন। অসমর্থিত সূত্র বলছে ৫০০র বেশি। তারপরও তিনি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আরো নানামুখী কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন।
 
একটা হিসাব যদি করেন তাহলে দেখা যাবে প্রায় ২ কোটি শিক্ষার্থী সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে অবস্থান নিয়েছে। তার সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের যদি যুক্ত করা হয় সেই সংখ্যা দাঁড়াবে ছয় কোটি। জঙ্গি তকমা লাগিয়ে জামাতে ইসলামী এবং শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে- যাদের উৎপত্তিস্থল মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসা থেকে একটি শিক্ষার্থীও এবারের আন্দোলনে এখনও পর্যন্ত মাঠে নামে নাই। যেখানে সাধারণ ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে যদি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নামে  তাহলে অবস্থাটা কোন পর্যায়ে যেয়ে দাঁড়াবে? সেই ভাবনা কি শেখ হাসিনার মাথায় আছে? 
এই নিরীহ নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের আবেগ বুঝতে ব্যর্থ হলে সরকারকে বিদায় নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। তারা আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে, তাদের নয় দফাতেও কোন কাজ হবে না শেখ হাসিনাকেই বিদায় নিতে হবে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে এতগুলো হত্যার বিচার যেমন হবে না তেমনি দেশে ফিরবে না সুশাসন, মানবাধিকার,গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকার। 
 
শুক্রবার রাজধানীর ঢাকার উত্তরা খুলনার জিরো পয়েন্ট এবং সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী পান্ডারা গুলি চালিয়েছে বলে খবর এসেছে। এটা যদি সঠিক হয় তবে এই আন্দোলন থামানো অসম্ভব হয়ে যাবে।