যে কারণে তারেক রহমানকে খালাস দিয়েছিলাম

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতাকে বিপ্লবের মাধ্যমে একজন স্বৈরশাসককে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করায় আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। ২০১৩ সালে একটি আলোচিত মামলায় একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাকে আইন অনুসারে খালাস দেয়ায় আমাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। দেশে তখন ছিল এক দমবন্ধ পরিবেশ। এই বিপ্লব আমাদের আশা দেখাচ্ছে এমন পরিবেশ থেকে উত্তরণের।

দেশ ছাড়ার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বানোয়াট অভিযোগ তোলা শুরু হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আমার কথিত অবৈধ সম্পদের খোঁজ শুরু করে এবং দেশের আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান আমি আসামির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রায় দিয়েছিলাম। সেই সময় দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকায় আমার বক্তব্য কোন গণমাধ্যম প্রচার করেনি। তাই এত বছর পর এই বিষয়টি নিয়ে কিছু বক্তব্য জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে চাই। 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি মানি লন্ডারিং মামলা দায়ের করা হয়েছিল শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর। মামলার মূল বিষয় ছিল একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্রয়াদেশ নিয়ে। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করা জরুরী। মামলাটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির টেন্ডার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত কোন দুর্নীতি নিয়ে ছিল না। ২০০২ সালে টেন্ডার প্রক্রিয়াতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবেই প্রতিষ্ঠানটি তখন কাজ পেয়েছিল। এখন পর্যন্ত কোন পক্ষ থেকেই এই টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বলে আমার জানা নেই।

টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও ক্রয়াদেশ পেতে দেরি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে খাদিজা ইসলাম যোগাযোগ করেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাথে, তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের পরামর্শে যিনি তাকে জানিয়েছিলেন যে জনাব মামুন প্রতিমন্ত্রীর পরিচিত। জনাবা খাদিজা আগে থেকেই জনাব মামুনকে চিনতেন এবং এই কাজটির জন্য তিনি তার সাথে কথা বলেন। পরামর্শক ফি’র বদলে জনাব মামুন ক্রয়াদেশ দ্রুত ছাড় করানোর ব্যাপারে জনাবা খাদিজা সহায়তা করতে সম্মত হন। এই বিষয়টি, জনাবা খাদিজা, নিজেই দাবি করেছেন মামলার জেরার সময়।

এই মামলার মূল অভিযোগ ছিল কাজ পাইয়ে দিতে জনাব তারেক রহমান জনাব মামুনের মাধ্যমে জনাবা খাদিজার কাছে অর্থ চেয়েছিলেন। জনাবা খাদিজা এরপর দেশের বাইরে একটি ব্যাংক হিসেবে অর্থ দিয়েছিলেন এবং সেই অর্থের একটা অংশ জনাব তারেক রহমান চিকিৎসা এবং ব্যক্তিগত কাজে পরবর্তীতে ব্যবহার করেছিলেন। তাই এই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় দুইজন গুরুত্বপূর্ন সাক্ষী ছিলেন যিনি অর্থ দিয়েছিলেন, অর্থাৎ খাদিজা ইসলাম, এবং অন্যজন হচ্ছেন এফবিআই’র ডেবরা লাপ্রোভোত্তে, যিনি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছিল এমন প্রমাণ দেখেছেন।

যেহেতু এই লেখার মূল বিষয় জনাব তারেক রহমানকে আমি কেন খালাস দিয়েছিলাম, আমি শুধু মামলার এই অংশটা নিয়েই আলোচনা করবো। 

প্রথমত, এই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় জনাবা খাদিজা কখনই দাবি করেননি, জনাব তারেক রহমান তার কাছে জনাব মামুনের মাধ্যমে অর্থ দাবি করেছিলেন, বা জনাব মামুন তারেক রহমানের নির্দেশে এই অর্থ দাবি করেন। এই দাবিটি করা হয়েছিল মামলার এজাহারে। অর্থাৎ, যিনি অর্থ দিয়েছেন বলে অভিযোগ, তিনি নিজেই যা দাবি করেননি তার ভিত্তিতে মামলার এজাহার তৈরি করা হয়েছিল। 

জনাবা খাদিজার সাথে তারেক রহমানের কোন ধরণের কোন যোগাযোগ হয়েছিল এমন কোন প্রমাণই নেই এবং বাদী তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইব্রাহীম কখনই বলেননি যে তারেক রহমান কখনও খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেছেন। তাই এজাহার ও বাদীর বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। তাই এই অর্থ প্রদান বা গ্রহণ প্রক্রিয়াতে তারেক রহমানের কোন সম্পর্ক কোন পর্যায়েই ছিল না।

এবার আসা যাক অভিযোগের দ্বিতীয় অংশে। এখানে দুইটি বিষয় আমাকে বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। 

প্রথমত, সিঙ্গাপুরে যে ব্যাংক হিসাব থেকে তারেক রহমান গোপনে অর্থ ব্যয় করায় তাকে মানি লন্ডারিং-এ জনাব মামুনের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেই ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা মোট অর্থের মাত্র দুই শতাংশের মত চিকিৎসা ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজে ব্যবহার করেছেন বলে জানা যায়। 

যদি তারেক রহমান এই ব্যাংক হিসাবের যৌথ মালিক হোন এবং এই অর্থ প্রদান বা গ্রহণের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকতেন জনাব মামুনের সাথে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই অর্থের একটা বড় অংশ ব্যয় বা উত্তোলন করে অন্য কোথাও জমা রাখার কথা। ২০০৩ থেকে ২০০৭, এই চার বছরে মাত্র দুই শতাংশ অর্থ নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার কথা না।

দ্বিতীয়ত, যেকোন আর্থিক দুর্নীতির ক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে আয়ের সাথে ব্যয় বা সম্পদের অসংগতি। তাই যেকোন দুর্নীতি বিষয়ক মামলায় অভিযুক্তদের আয়ের হিসাব এবং সম্পদ বিবরণী গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই মামলায় জনাব তারেকের কোন আইনজীবী না থাকায় ন্যয়-বিচার নিশ্চিতের স্বার্থে আমি ২০০৭ সালের জুলাই মাসে দুদকে দাখিল করা তার সম্পদের বিবরণী তলব করি। 

সেখানে দেখা যায় এফবিআই’র ডেবরা লাপ্রোভোত্তে যেই সাপ্লিমেন্টারি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অর্থ উত্তোলন ও ব্যয় করার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন, এবং যে ব্যয় গোপন করার জন্য জনাব তারেককে আসামী করা হয়েছিল, সেই সাপ্লিমেন্টারি ক্রেডিট কার্ডটির কথা ২০০৭ সালের সম্পদ বিবরণীতে জনাব তারেক উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তিনি গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের থেকে অর্থ নিয়েছিলেন তা তিনি গোপন করেননি। এই অর্থ ধারও হতে পারে, বা ব্যবসায়ীক অংশীদার হিসেবে পাওনা টাকাও হতে পারে। কিন্তু এতে সন্দেহাতীতভাবে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার সাথে জনাব তারেক রহমান জড়িত বা ঐ ব্যাংক হিসাবটির অংশীদার বা মালিক তিনি।

এই ক্ষেত্রে বাদী নিজেই তার সাক্ষ্যে কোন দালিলিক প্রমাণ না সাক্ষ্যের উদ্ধৃতি না দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ধারণা থেকে দাবি করেন যে জনাব মামুন, জনাব তারেকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে ক্রয়াদেশ পাইয়ে দিতে অর্থের বিনিময়ে কাজ করতেন। 

কোন সুস্থ বিচারিক প্রক্রিয়াতে ব্যক্তিগত ধারণার কোন স্থান নেই। কেউ ব্যক্তিগত ধারণা থেকে যদি সাক্ষ্যে বলে বসে আমার ধারণা অমুক ব্যক্তিই এই খুন করেছে তাহলে কি আমরা তাকে খুনি ধরে নিব নাকি অন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে সেই দাবি যাচাই করবো?

উপরে উল্লিখিত সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়াতে জনাব তারেক রহমানকে আমি বেকসুর খালাস ঘোষণা করেছিলাম। এর ফলশ্রুতিতে আমার উপর নেমে এসেছিল নির্যাতনের খড়্গ এবং আমাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল, তোলা হয়েছিল দুর্নীতির অভিযোগ।

তাই ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এই লেখাটি লিখতে বাধ্য হলাম।