২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: ভেন্যু পরিবর্তনেই মূল রহস্য
আজ ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি সমাবেশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বোমা হামলা হয়। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। সে সময়কার পত্র-পত্রিকা এবং আওয়ামী লীগের প্রচারযন্ত্রের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিএনপি। ফলে ২১ আগস্ট কেন ঘটেছিল আর এর নেপথ্যে কার হাত ছিল, সেটা শত চেষ্টা করেও প্রকাশ করা যায়নি কিংবা যতটুকু প্রকাশ করা হয়েছিল তা বিশ্বাস করানো যায়নি। এর মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার ‘জজমিয়া নাটক’ এমনভাবে হাজির করা হলো, যাতে জনগণ রীতিমতো বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। এর ভেতর দিয়ে বিএনপি জোট সরকার, সরকারপ্রধান এবং হাওয়া ভবনকে দাঁড় করানো হয় আসামির কাঠগড়ায়। আমি তখন দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় নিউজ এডিটর থাকার কারণে ২১ আগস্টের অনেক বিষয় খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়।
বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সে সময় দেশি ও আন্তর্জাতিক একটি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরই অংশ হিসেবে ওই বছরের ২১ মে সিলেটের হযরত শাহজালালের (র.) মাজার এলাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা হয়। মাত্র তিন মাসের মাথায় হামলা হয় বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে। দেশের ইতিহাসে যে কয়টি কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা অন্যতম। ওই ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও নিহত হন আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানসহ ২২ নেতা-কর্মী।
২১ আগস্টের ঘটনার আগে-পরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণ করলে জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে সেদিন এই ষড়যন্ত্র কেন হয়েছে? কারা করেছে? কারা এ ঘটনায় লাভবান হয়েছে? স্বাধীনতার পর থেকে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের অফিসপাড়া বরাবরই ছিলোতাদের কর্মী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ভিন্নমতের লোকেরা ওই এলাকায় চলাফেরা করতে সাহস পেত না। তার ওপর তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনের দাবিতে আওয়ামী লীগের বেশ জোরালো কর্মসূচি চলার কারণে তাদের কর্মী বাহিনীর পদভারে থাকত জমজমাট। কাজেই বাইরের কারো পক্ষে আওয়ামী লীগের দূর্গে গিয়ে বোমা হামলা চালানো ছিল একেবারেই অসম্ভব।
সে দিনের ঘটনার বিশ্লেষণে গেলে আমরা কী দেখি? প্রথমত, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার ঘটনা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অবশ্যই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস ঘটনা। এমন একটি ঘটনা পূর্ব পরিকল্পনা ও নিখুঁত নিশানা ছাড়া কিছুতে সম্ভব নয়। নিখুঁত পরিকল্পনার জন্য সমাবেশের ভেন্যু, সভামঞ্চের স্থান সম্পর্কে হামলাকারীদের কাছে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। তাদের জানা থাকতে হবে, কোথায়, কোন স্থানে আওয়ামী লীগের সমাবেশ হবে। সেভাবেই তারা তাদের হামলার নিখুঁত পরিকল্পনা সাজাবে। এটাই অপরাধ বিজ্ঞানের নিয়ম।
দ্বিতীয়ত, সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল মুক্তাঙ্গনে। মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা আগে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করা হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। এই অল্প সময়ে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের পক্ষেই এমন হামলা সম্ভব নয়। তাছাড়া মুক্তাঙ্গনের পরিবর্তে বিবি এভিনিউতে সমাবেশের কথা জানাজানি যখন হয়, ততক্ষণে ওই এলাকায় দলের নেতা-কর্মীদের ভিড় জমে। এই ভিড়ের মধ্য দিয়ে বাইরে থেকে কারো পক্ষে বোমা বহন করে সেখানে নেয়া, রেকি করা এবং হামলা চালানো এসব কল্পনাতীত।
তৃতীয়ত, হামলাকারীদের রেকি করার বিষয়টি উঠে আসে প্রথম আলো পত্রিকার ২০১৮ সালের ২১ আগস্ট সংখ্যায়। সেখানে কয়েকজনের জবানবন্দির আলোকে ‘যারা যেভাবে পরিকল্পনা ও হামলা করেছিল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে। বিস্তারিত রিপোর্টের একটি লাইন, ‘হামলার আগের দিন ২০ আগস্ট কাজল ও আবু জান্দাল বঙ্গবন্ধু এভিন্যু গিয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে আসেন’। পুলিশের কাছে দেয়া তথ্যমতে, আবু জান্দাল এবং কাজলই সমাবেশে প্রথম গ্রেনেড ছুড়ে মারে।
এখন প্রশ্ন হলো...
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের জন্য নির্ধারিত স্থান ছিল ঢাকার ‘মুক্তাঙ্গন’। রাজধানীতে একটি সমাবেশ করার জন্য ভেন্যু হিসেবে ‘মুক্তাঙ্গন’ বরাদ্দ চেয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নিয়মানুযায়ী ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে আবেদন জানায়। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ সমাবেশের জন্য ‘মুক্তাঙ্গন’ বরাদ্দও দিয়ে দেয়। সিটি কর্পোরেশন থেকে ভেন্যু হিসেবে ‘মুক্তাঙ্গন’ বরাদ্দ পেয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক সহিদুল ইসলাম মিলন, ‘মুক্তাঙ্গনের’ সমাবেশে মাইক ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে ২০০৪ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (পূর্ব) বরাবর আবেদন করেন। আবেদনপত্রে বিষয় হিসেবে লেখা হয়, “২১ আগস্ট ২০০৪ ইং মুক্তাঙ্গনে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সমাবেশে মাইক ব্যবহারের অনুমতি প্রসঙ্গে”। চিঠিতে স্পষ্ট করে লেখেন যে, সমাবেশ হবে “জিপিও পার্শ্বস্থ মুক্তাঙ্গনে।” ১৯ আগস্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষ মুক্তাঙ্গনের সমাবেশে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
ওই সময় বেশ গরম থাকায় সমাবেশে আগতদের জন্য সিটি কর্পোরেশন সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে। পুলিশ মুক্তাঙ্গন ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কারণ মাত্র তিন মাস আগে সিলেটে বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলা হয়। এ ঘটনার কারণে বিএনপি সরকার এমনিতেই বিবৃতকর অবস্থায় ছিল। ২১ আগস্ট দুপুর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বিঘ্নে সমাবেশে যোগ দেয়।
ওই দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত সবাই জানে সমাবেশ হবে মুক্তাঙ্গনে। পুলিশ ও সাংবাদিকদের অনেকে মুক্তাঙ্গনে অবস্থান নেন। কয়েকটি মিছিলও এসে জড়ো হয় সেখানে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে মুক্তাঙ্গনে সমবেত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে রওনা হন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র দিকে। এরই মধ্যে খবর আসে সমাবেশ মুক্তাঙ্গনে হচ্ছে না, সমাবেশ হবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে। সেখানে ট্রাক দিয়ে তাৎক্ষণিক অস্থায়ী সভামঞ্চও তৈরি করা হয়। মুক্তাঙ্গন থেকে পুলিশ ও সাংবাদিকরাও ছুটতে থাকেন বিবি এভিনিউর দিকে। ততক্ষণে বিবি এভিনিউ দলীয় নেতা-কর্মীতে ভর্তি হয়ে যায়। ফলে পুলিশ এবং সাংবাদিকদের অনেকে সভামঞ্চের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।
দেখা যাচ্ছে, সমাবেশের দিন দুপুর বেলা সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে নেয়া হয় ‘বিবি এভিন্যুতে’। হামলাকারী জঙ্গিরা কীভাবে জানল, আওয়ামী লীগের সমাবেশ পল্টনের মুক্তাঙ্গনের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হবে? জঙ্গিরা ‘মুক্তাঙ্গন’ রেখে গ্রেনেড হামলা চালাতে ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’ রেকি করলো কেন? কে জঙ্গিদের ভেন্যু পরিবর্তনের তথ্য দিয়েছে?
দুদিন আগে সাঈদ খোকন নেত্রীকে জানান
২০২১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ‘স্মৃতির পাতা থেকে জানা-অজানা দুই একটি কথা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। সাঈদ খোকন সভায় অন রেকর্ড বলেছেন, ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার দুই দিন আগে এই ধরনের হামলার আশঙ্কার কথা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘নেত্রী সাংগঠনিক সফর শেষে সুধাসদনে বিশ্রাম করছিলেন। কারও সঙ্গে তিনি দেখা করছিলেন না। রাত তখন ১০টা। আমি সুধাসদনে উপস্থিত হই। সুধা সদনের দোতলায় দেখা হলো। বললাম, সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে একটি আশঙ্কাজনক বার্তা দিতে আব্বা (সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) পাঠিয়েছেন। একটি হামলা চূড়ান্ত হয়েছে। সূত্রমতে, এই হামলাকারী ঢাকার ভেতরে চলে এসেছে। তাদের হামলার স্থান- সুধাসদনের এই বাসা, আপনার যাতায়াতের পথ ও সেখানে যদি না হয়, তাহলে আমাদের অনুষ্ঠানে (সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশস্থল)। আব্বা বলেছেন, যেভাবে হোক আপনি আমার সঙ্গে চলেন। আমাদের বাসায় চলেন। এখানে আপনি একেবারেই নিরাপদ নন। এখান থেকে সরে যেতে হবে।’
সাঈদ খোকন বলেন, ‘নেত্রীকে বললাম, আপনারও অনেক সূত্র থাকে, নেটওয়ার্ক থাকে, আপনি কনফার্ম করে নেন বিষয়টি। তবে এটা আপনার জন্য নিরাপদ হচ্ছে না। যে কোনো সময় যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘তখন জবাবে নেত্রী (শেখ হাসিনা) অনেকক্ষণ চুপ থেকে পরে আমাকে বললেন, এতো ভয় পেলে হবে না। এতো ভয় পেলে কী রাজনীতি হয়? হেসে বললেন। অনেক অনুরোধ করলাম, ওখান থেকে চলে আসতে। বললেন, তুই যা, চিন্তা করিস না। আল্লাহ ভরসা। যা হওয়ার হবে। রাত হয়েছে, বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমা, এতো ভয় পেলে রাজনীতি হয় না। দেখা যাবে কী হয়!’
সাঈদ খোকন আরো বলেছেন, ‘২০০৪ সালে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার কথা তারা দুই দিন আগেই জানতে পেরেছিলেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে, মরহুম মেয়র মোহাম্মদ হানিফ কীভাবে দুই দিন আগেই ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার কথা জানতে পেরেছিলেন? কার কাছে জেনেছেন? এতো বড় হামলার কথা জেনেও তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালেন না কেন? এই গোপনীয়তার রহস্য কি?
- এমন একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে কি জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন?
- শেখ হাসিনাকে তার সমাবেশে হামলার কথা দুই দিন আগে জানানো হলেও তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? শেখ হাসিনা কি এই বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছিলেন?
- শেখ হাসিনা তখন ছিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী, সুতরাং নিরাপত্তার কারণে ভেন্যু পরিবর্তন করতে হলে সেটি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। শেখ হাসিনা কিংবা তার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কেন জানানো হলো না?
- ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের ‘ভেন্যু’ পরিবর্তনের রহস্য বের করা গেলে ২১ আগস্টের ঘটনার অনেক কিছু উম্মোচিত হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১/১১ সরকারের কারাগার থেকে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন যে, মুক্তাঙ্গনে অনুমতি না পেয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে জনসভা করি। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে এত বড় সমাবেশের মঞ্চ কি ট্রাকের ওপর হয়?
জবানবন্দিতে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, মঞ্চে নেতারা মানব ঢাল বানিয়ে তাকে রক্ষা করেন। তিনি আরও বলেন, এসবির প্রোটেকশন দলের সদস্যরা তাদের অস্ত্র থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও ডিএমপির প্রোটেকশন দল কোনো ভূমিকাই রাখেনি। সে সময় তিনি দাবি করেছিলেন, তার গাড়িতেও গুলি করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সেই গাড়ি সিআইডি এবং ইন্টারপোল প্রতিনিধিদের দেখাননি। এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার অবস্থার খোঁজ নিতে এবং সহানুভূতি জানাতে সুধাসদনে গেলে তাকে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর সারাদেশে দুদিনের হরতাল আহ্বান করে আওয়ামী লীগ। বাস-ট্রেনসহ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে গোটা দেশ উত্তাল করে তোলা হয়। নানা কারণে প্রথম দিকে গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হলেও ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে তদন্ত সঠিক পথে এগুতে থাকে। মুফতি হান্নানের গ্রেফতারে প্রমাণিত হয় ‘জজ মিয়ার’ গ্রেফতার এবং জবানবন্দীর কারণে ২১ আগস্ট হামলা মামলার তদন্ত থেমে যায়নি। সরকারের কাছে ‘জজ মিয়ার’ জবানবন্দি ‘যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য’ মনে হয়নি।
বিএনপি সরকারের কাছে ‘জজ মিয়ার’ জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে ‘জজ মিয়ার জবানবন্দির’ মাস তিনেক পর মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার হতে হতো না। বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার ২১ আগস্ট হামলা মামলার তদন্ত হয়েছে। প্রত্যেক তদন্তে মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট হামলা মামলার এক নম্বর আসামি ছিল। তার মানে বিএনপি সরকার প্রকৃত অপরাধীকেই ধরেছে।
২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার আগে পর্যন্ত সময়কালে ২১ আগস্ট হামলা মামলার তদন্ত অব্যাহত রাখলেও সময়ের অভাবে তদন্ত শেষ করে যেতে পারেনি। তবে তদন্ত শেষ করতে না পারলেও ২১ আগস্ট মামলার প্রধান আসামি অর্থাৎ এক নম্বর আসামি মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করতে পারা অবশ্যই ২১ আগস্ট মামলা তদন্তের অগ্রগতিতে বিএনপি সরকারের একটি বড়ো সাফল্য।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়ার বিচার কার্যক্রম দূরে থাক, যেখানে তার ব্যাপারে পুলিশ চার্জশিটও হয়নি। আওয়ামী লীগের জজ মিয়াকে ইস্যু বানিয়ে মিথ্যা গল্প প্রচার করে, জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সুকৌশলে ২১ আগস্টের প্রকৃত রহস্য আড়াল করে প্রধান প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা।
এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা দরকার। বিএনপি পরবর্তী সরকার ২০০৮ সালের ৯ জুন ২১ আগস্ট মামলার প্রথম চার্জশিট দাখিল করে। বিএনপি সরকার যেভাবে জজ মিয়ার জবানবন্দী আমলে নেয়নি, একইভাবে বিএনপি পরবর্তী সরকারও জজ মিয়ার জবানবন্দী আমলে নেয়নি। ফলে জজ মিয়াকে বাদ দিয়েই চার্জশিটে মুফতি হান্নানকে মামলার এক নম্বর আসামি করে মোট ২২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে।
পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ২০১১ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল কাহহার আকন্দ আদালতে দ্বিতীয় দফা ২১ আগস্ট হামলার চার্জশিট দাখিল করেন। এ চার্জশিটেও জঙ্গি মুফতি হান্নান ছিল এক নম্বর আসামি। এখানে বলে রাখা ভালো, আব্দুল কাহার অবসরে যাওয়ার পর তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে এনে এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পরই একচোখা নীতি অবলম্বন করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আসামি করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেন। তার পুরস্কার হিসেবে আব্দুল কাহার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ পান।
আওয়ামী লীগের এই নেতা হাওয়া ভবন তথা তারেক রহমানকে দায়ী করে চার্জশিট দাখিল করেন। তারেক রহমানকে দায়ী করার পক্ষে হাজির করা হয় মুফতি হান্নানের একটি কথিত জবানবন্দী। যার সাথে মিল রেখে একটি বানোয়াট ভিডিও ইউটিউবে ছাড়া হয়েছে (উল্লেখ্য জবানবন্দী দেয়া হয় বিচারকের সম্মুখে, এর ভিডিও প্রকাশ করা সম্ভব নয়)। এতে দেখা যায়, পাশে থেকে মুফতি হান্নানকে পুলিশ কর্মকর্তারা শিখিয়ে দিচ্ছেন কী কী বলতে হবে! তবে এরপরও ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মুফতি হান্নান আদালতে লিখিতভাবে আগেকার জবানবন্দী প্রত্যাহার করে বলেন যে, তিনি নিজে উক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী বা লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে হাওয়া ভবনে কখনই দেখা করেননি। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলেও উল্লেখ করেছেন। বরং আগে রিমান্ডে নিয়ে মারধর করে অচেতন অবস্থায় স্বীকারোক্তিতে স্বাক্ষর করায় পুলিশ! নিজ দলীয় এতগুলো নেতাকর্মী নিহত হওয়া স্বত্ত্বেও কি আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা এই গ্রেনেড হামলার আদৌ সঠিক বিচার চেয়েছিলেন? যদি চাইতেন, তাহলে তাদের আদালতে মুফতি হান্নানকে জেরা ও বিচার না করে তড়িঘড়ি ফাঁসিতে লটকালেন কেন? যেহেতু ৪১০ দিন রিমান্ডের নির্যাতনের পরে নেয়া স্বীকারোক্তি মুফতি হান্নান নিজেই আদালতে দরখাস্ত দিয়ে প্রত্যাহার করে গেছেন এবং তাতে তারেক রহমান ওই হামলার সাথে জড়িত নন বলে আদালতকে জানিয়ে গেছেন। এ ঘটনার পরপরই মুফতি হান্নানকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। আসলে হান্নানকে জেরা করার কোনো সুযোগ রাখেনি আওয়ামী লীগ- কারণ কাউকে ফাঁসাতে হবে বলে। এরপরে তারা এই মামলায় তারেক রহমানকে ফাঁসিয়েছে পলিটিক্যাল রায়ে, যা দেশবাসীর কাছেও পরিষ্কার।
আগে বলেছি, এখনো বলছি, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের ভেন্যু পরিবর্তনের রহস্য বের করা গেলে ২১ আগস্টের ঘটনার অনেক কিছুই উম্মোচিত হয়ে যাবে।