কী রেখে গেলেন শেখ হাসিনা?
প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার দলের নেতা-কর্মীরা হতাশ আর হতবাক; ক্ষুব্ধও অনেকে। ‘শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা পালায় না’ বলে যে অহংকার ছিল আওয়ামী লীগের, সেটি যে ফাঁকা বুলি তা প্রমাণিত হলেও আওয়ামী লীগের লোকজনের তা বিশ্বাস করতে শুধু কষ্টই হচ্ছিল না, বেগও পেতে হচ্ছিল বেজায়। ক্ষমতা শেখ হাসিনাকে এতটা অন্ধ করে দিয়েছিল যে, একে একে তিনটি প্রহসন ও জালিয়াতির নির্বাচন করেছেন তিনি।
উন্নয়নের মুলা ঝুলিয়ে তিনি একটি গোষ্ঠীকে তার হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন, আর দেশের মানুষের একটি অংশকেও তিনি প্রায় মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। বিষয়টি এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে শেখ হাসিনা নিজেই জনগণের সামনে ছুঁড়ে দেন এক প্রশ্ন- বিকল্প কে? মানে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই এই বিশ্বাসটা শেখ হাসিনা নিজে প্রবলভাবে করতেন, আর সেই বিশ্বাসটা তিনি সাধারণের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করেছেন।
এ কথা বলে টেলিভিশনের টকশোর এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীকে শেখ হাসিনা মহা দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলতে পারলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে শেখ হাসিনা নিয়ে যেমন আগ্রহ ছিল না, তেমনি শেখ হাসিনার বিকল্প থাকা না থাকা নিয়েও উৎকণ্ঠা ছিল না। মানুষ খুব ভাল করে জানেন এবং বিশ্বাস করেন, কেউই অপরিহার্য নয়। কারও জন্যই কোন কিছু বসে থাকে না, আর প্রকৃতি কোন স্থানই শূন্য রাখে না।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মহা অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা যখন হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়ছিলেন, তখন তাকে দেশের প্রায় সব মানুষ পলায়ন বললেও ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী একে দেশত্যাগ বলে সান্ত্বনা খুঁজতে লাগল। তা দেশ ছেড়ে পালানোই হোক আর দেশত্যাগই হোক, শেখ হাসিনা নাকি ভারত গমনের সময় এক কাপড়ে চলে গেছেন। দুপুরের খানাটাও নাকি খেতে পারেননি তিনি।
প্রশ্ন জাগে শেখ হাসিনা কিছুই নিয়ে যাননি, কিন্তু কী রেখে গেছেন? সাধারণভাবে বলা যায় লাখো নেতা-কর্মী, সমর্থকের জন্য হতাশা রেখে গেছেন, গ্লানি রেখে গেছেন, তবে তাদের মুখ লুকানোর জায়গা রেখে যাননি। বৈষয়িকভাবে তিনি হয়তো অগাধ সম্পদ ও সম্পত্তি রেখে গেছেন, কিন্তু তার চেয়ে বেশি যেটা তিনি রেখে গেছেন, তা হচ্ছে মানুষের ঘৃণা। প্রচণ্ড জিঘাংসা যার রাজনৈতিক জীবনের হাতিয়ার, সেই শেখ হাসিনা যদি জানতেন তাকে নিয়ে দেশের মানুষ তো বটেই, তার দলের নেতা-কর্মীরা কি বলছেন, তাহলে শেখ হাসিনা হয়তো অনুতপ্ত হতেন।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী যারা তাদের নেত্রীর উন্নয়নে মুগ্ধ আর তার কান্নায় শোক স্তব্ধ হতেন, তারা এখন বাকরুদ্ধ। এই বাকরুদ্ধ মানুষদের অনেকেই এখন বিশ্বাস করেন আর বলতেও শুরু করেছেন, শেখ হাসিনা দেশের মানুষের ওপর চরম জিঘাংসা চরিতার্থ করেছেন। ক্ষমতা ধরে রাখতে এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ শেখ হাসিনা করেছিলেন জেনে তারা লজ্জিতই শুধু নয়, শেখ হাসিনার প্রতি ঘৃণাও উগরে দিচ্ছেন।
শেখ হাসিনা, আপনি সব সময় গর্ব আর অহংকার করতেন মেট্রো রেল নিয়ে, পদ্মাসেতু নিয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেস নিয়ে। দেশের ১৬ কোটি মানুষকে আপনি খাওয়ান এ কথা বলে আপনি আত্মপ্রসাদে ভুগেছেন। আপনি শুনলে অবাক হবেন, এসব উন্নয়নের প্রতীক এখন ঘৃণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এসব অবকাঠামো গড়ার পেছনে যে দুর্নীতির কাহিনি বের হয়ে আসছে, তাতে এসব অবকাঠামো মানুষ ব্যবহার করছে একরাশ ঘৃণা নিয়ে।
জনগণের অর্থে যে সম্পদ নির্মিত হয়েছে, আপনার বাক্যবাণের কারণে সেই সম্পদ ব্যবহারে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ছিল না কখনোই। বরং আপনার পতনে সেই অস্বস্তি থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। এইসব অবকাঠামো মানুষ ব্যবহার করছে ও করবে, তবে সেটা ঘৃণা নিয়ে। অপশাসন ও জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য-বিদ্রূপ করার প্রতিবাদ মানুষের মধ্যে তীব্র ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।
শেখ হাসিনা দেশে আপনি কিছুই ফেলে যাননি, মানুষের একরাশ ঘৃণা ছাড়া।
লেখক: সাংবাদিক