বিএনপি: জিয়া-খালেদার হাত ঘুরে তারেক রহমান

বাঁ থেকে খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমান ও তারেক রহমান। ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? ঘোষণা দিয়ে মানুষ হত্যা। আইন করে গণমাধ্যম বন্ধ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা রোহিত। সাংবাদিকরা বেকার। রাজনৈতিক দলের অফিসে ঝুলছে তালা। ভেড়ার পালের মতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গণভবনে। কারও কোনো স্বাধীনতা নেই, নেই কারও স্বতন্ত্র অবস্থা। অন্যদিকে, দুর্ভিক্ষে ক্ষতবিক্ষত দেশ। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। নেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। একটাই দেশ তার একজনই নেতা। দেখা দেয় নেতৃত্বের শূন্যতা। শুরু হয় দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। এমনই একদলীয় শাসনের বিপরীতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল সময়ের দাবি। পোড় খাওয়া ক্ষুব্ধ রাজনীতিবিদদের মনের সেই সুপ্ত বাসনা জাগিয়ে তোলার দায়িত্বটি পালন করেছেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার আগমন খুবই আকস্মিক, কিন্তু সময়ের দাবির কাছে বাস্তবিক ও স্বাভাবিক। অনেকটা ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে তার। 

রাজনীতির এমন ঘনঘোর অমানিশা কাটাতে সময়ের চাহিদা এবং দেশের দাবিতে এসেছিলেন তিনি। তবে কোন চোরাগলি দিয়ে নয়, রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র করে নয়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশপ্রেমিক সিপাহি-জনতার সম্মিলিত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে এই মহান নেতার। ১৯৭২ থেকে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক ব্যর্থতার বিপরীতে সাফল্যের রূপকার হয়ে আসেন তিনি। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির কবর রচনা করেন চিরকালের সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবর রহমান।

জিয়াউর রহমান যখন নেতৃত্বে আসেন তখন দেশে কোন রাজনীতি ছিল না। ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া একদলীয় বাকশাল, বাকি রাজনৈতিক দল ছিল নিষিদ্ধ। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করা সত্ত্বেও শেখ মুজিব আবির্ভূত হলেন একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসন ব্যবস্থার নেতা হিসেবে। পরিণত হলেন ফ্যাসিবাদের আইকনে।নির্বাচন ছাড়াই  জাতীয় সংসদে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়। ফলে রুদ্ধ হয় ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই সুযোগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের সবচেয়ে  প্রিয় সহযোদ্ধা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অপেক্ষাকৃত জুনিয়র অফিসাররা রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দখল করে নেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা।

একই বছরের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে পাল্টা ক্যু’র মাধ্যমে খন্দকার মোশতাকও ক্ষমতাচ্যুত হন। গৃহবন্দি হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। এতসব ক্যু পাল্টা ক্যু’র বিরুদ্ধে ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক সংহতির মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন ছিল স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, বহুদলীয় গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার, সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। সেই পরিবর্তনের নেতৃত্বে ছিলেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক জেনারেল  জিয়াউর রহমান। এই পরিবর্তনের জন্য তিনি রাজনীতি ফিরিয়ে আনেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন, গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

এই রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যেতে চাই ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেঁস্তোরায়। সেদিন এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়া ঘোষণা দেন নতুন এই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি)। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। প্রতিষ্ঠাকালে দলের অন্যতম সৌন্দর্য ছিল,ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী সবার অংশগ্রহণ।

সেদিন তিনি দ্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, বাস্তবিক পক্ষে জাতীয় প্রয়োজনের জন্যই নতুন দল করা হচ্ছে, এই দল জাতিকে দৃঢ় করবে এবং দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। অনেকে তখন মনে করেছেন, এই স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু স্বাধীনতার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা সম্ভব। বিপুল জাতীয় সম্পদ রয়েছে তার সদ্ব্যবহার করলে অল্প সময়ের মধ্যে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমি দেখেছি হাজার হাজার নর-নারী দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের ভুললে চলবে না, প্রশ্ন করতে হবে কেন তারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাদের আস্থা, দেশ স্বাধীন হলে তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। তাদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই নতুন দলের অঙ্গীকার। 

প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার অঙ্গীকার, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার চেতনা সৃষ্টি। ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল দলের মৌল আদর্শ। রাষ্ট্রনীতির চারটি মৌলিক আদর্শ তথা গণতন্ত্র, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র, এই ছিল দলীয় কর্মসূচির মর্মবাণী।

বিএনপি গঠনের পর চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২০৭ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার একান্ত উদ্যোগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর মাত্র ১৩ দিনের মাথায় ৩০ মে চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সৈন্যের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদাতবরণ করেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন শাহাদাতবরণ করেন তখন বিএনপির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। যার প্রমাণ মেলে তার জানাজায় উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল দেখে। গোটা জাতি পালন করে ৪০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। তৎকালীন সেনাপ্রধান ধুরন্ধর এরশাদ এটাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলেন। এখান থেকেই তিনি তার পরবর্তী পরিকল্পনা নির্ধারণ করে ফেলেন।প্রথমেই সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার যারা তার চলার পথে কাটা হয়ে দাড়াঁতে পারে তাদের রাতারাতি কোর্ট মার্শাল করে কতক ফাঁসি, কতক বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দিয়ে সেনানিবাস থেকে দূরে সরিয়ে দেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করানো এবং বিএনপির চেয়ারম্যান পদে তাকে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে এরশাদের নেপথ্য ভূমিকা ছিল জোরালো।

বেগম খালেদা জিয়া তখন গৃহবধূ থাকলেও এরশাদের ভয় ছিল তিনি রাজনীতিতে আসলে এরশাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণেই তড়িঘড়ি করে বিচারপতি সাত্তারকে সামনে আনা হয়। এরশাদের পরিকল্পনায় বেগম খালেদা জিয়ার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করা হয় বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে। কারণ তিনি জানতেন বেগম জিয়া একবার প্রেসিডেন্ট হলে আর তাকে চোরাগলি পথে হটানো যাবে না।সে জন্য তিনি গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে দুর্বলচিত্তের বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে করেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর সকল দলের অংশগ্রহণে তীব্র প্রতিযোগিতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন বিচারপতি সাত্তার এবং মাত্র তিন মাসের মাথায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত হলেন। দুর্বলচিত্তের বিচারপতি সাত্তার ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে ধীরে ধীরে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন এবং রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেন।

এরপর বিএনপির রাজনীতিতে সামনে চলে আসলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যখন রাজনীতিতে আসেন সেটা অনেককে চমকে দিয়েছিল। ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল এরশাদের। খালেদা জিয়া প্রথম জনসমক্ষে বক্তব্য রাখেন ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়া যদি তখন বিএনপির হাল না ধরতেন তাহলে বিএনপি নিঃসন্দেহে গভীর সংকটে পতিত হতো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, শামসুল হুদা চৌধুরী, মওদুদ আহমদ, ডাক্তার মতিন গং তখন বিএনপি ভেঙে নতুন নতুন দোকান খোলা শুরু করলেন; যারা পরবর্তীতে এরশাদের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই দুর্দিনে একক হাতে দলকে সামলে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে বেগম জিয়াকে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। অবশ্য ততক্ষণে তিনি রাজনীতির মাঠে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন। এরশাদের দমন-পীড়ন, নির্যাতন পায়ে ঠেলে আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে নিতে থাকেন। সঙ্গে ছিল তার তরুণ বাহিনী ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, কৃষক দল; সবাই ছিল এক কাতারে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ১৫ দল, সাতদল এবং জামায়াতে ইসলামী যখন যুগপৎ আন্দোলন করছে তখন এক পর্যায়ে এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারী সকল সংগঠন এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তার আগে তিনি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ১৪ দলের জনসভায় ঘোষণা দেন এরশাদের অধীনে যারা নির্বাচনে যাবে তারা জাতীয় বেইমান। কিন্তু দুদিন পরেই সেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দেশের জনগণের কাছে চিহ্নিত হলেন জাতীয় বেইমান হিসেবে এবং নির্বাচন বর্জন করার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া হলেন আপসহীন নেত্রী।

শেখ হাসিনা এবং জামায়াতে ইসলামী সংসদে এরশাদের দোসর হিসাবে যোগ দিলেন। আর রাজপথে থাকলেন খালেদা জিয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং নির্বাচনের ডামাডোলে প্রথম দিকে আন্দোলনের মাঠ একটু থিতিয়ে পড়ে। কিন্তু বেগম জিয়া ঘরে উঠে যাননি, বরং পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের নিয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। সঙ্গে পেলেন ১৫ দল থেকে চলে আসা ৫ দলীয় বাম জোট এবং আরও কিছু ছোটখাট দলকে।

এরশাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মধুচন্দ্রিমা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। আবার তাকে নামতে হলো রাজপথে। আবার শুরু হলো যুগপৎ আন্দোলন। দীর্ঘ ৯ বছর একটানা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত পতন ঘটলো এরশাদের। আসলো ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পত্রপত্রিকা এবং বিভিন্ন সংস্থা জরিপ চালিয়ে বলে দিলো নির্বাচনে বিজয়ী হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী জোট। শেখ হাসিনা এক বিদেশি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন, বিএনপি পাবে মাত্র ১০ আসন। বিএনপি হবে বিরোধী দল। কিন্তু সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে  ১৪০ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেন বেগম খালেদা জিয়া। ক্ষমতার পাদপ্রদীপে আবারো জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। 

বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরেই বাংলাদেশের মাটিতে সূচিত হয় ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলে ধ্রুপদী গণতন্ত্র সংসদীয় ব্যবস্থা। বেগম খালেদা জিয়া হলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি নির্বাহী প্রধান। এরশাদের ফেলে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি, দুর্নীতিবাজ প্রশাসন, অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনার বিপরীতে খালেদা জিয়া যখন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে ব্যস্ত তখন শুরু হয় আবার ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এবং গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ করে গোটা দেশ অচল করে ফেলে। দাবি একটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে। বেগম জিয়া নিয়ম রক্ষার জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করলেন। একই বছর ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১৮ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধীদলের আসন অলংকৃত করেন বেগম খালেদা জিয়া। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন বিএনপিকে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেভাবে নাস্তানাবুদ করে পদত্যাগ করানো হয়েছে তাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু সে সময় হিসাব করে দেখা গেছে, ৪৫টি আসনে নৌকা এবং ধানের শীষের প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। অর্থাৎ, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ইসলামী ১৯৯১ সালে যেভাবে অঘোষিত সমঝোতা করে নির্বাচন করেছিল সেটা যদি অব্যাহত থাকতো তাহলে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির বিজয় সুনিশ্চিত। ২০০১ সালে আবারও সেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৪ দলীয় জোট ভূমিধস বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন করে। ধারণা করা হয়েছিল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে। কারণ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সবগুলো নির্বাচন দেশে এবং বিদেশে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। অর্থাৎ, শেখ হাসিনা সারাজীবন নির্বাচিত হবেন, ক্ষমতায় থাকবেন এবং বিরোধী দল বিএনপির ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাবেন। এটাকে এক ধরনের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব বলা চলে।

কিন্তু দিন যে বদলে গেছে, মানুষের মনে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট এমনভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছে যে তারা আজ ফুসে উঠেছে দেশনায়ক তারেক রহমানের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে। জবর-দখল করে ক্ষমতায় জেঁকে বসা হাসিনার সরকারকে তারা এখন হটাতে চায়। ভোটের অধিকার ফিরে পেতে চায়, গণতন্ত্র ফিরে পেতে চায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায়; সর্বোপরি মানবাধিকার বাস্তবায়ন চায়। এবারও জনগণের সেই আন্দোলনের পুরোধা জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান। তার সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সিদ্ধান্তে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। আর এই ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তে সুশীল সমাজের একটি অংশ সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। তারা বলতে থাকে- বিএনপি শেষ হয়ে গেল, এই দলটি আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু তারেক রহমান তার সিদ্ধান্তে অটল। তিনি এই ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করার জন্য দলকে আবার সুসংগঠিত করলেন। ধীরে ধীরে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করা শুরু করলেন। আউয়াল কমিশন ৭ জানুয়ারির যে প্রহসনের নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়েছে তার বিরুদ্ধে গড়ে তুললেন তুমুল গণসমর্থন। এখনকার অগ্রসরগামী জেনারেশন জেড ভুলতে বসেছে নির্বাচন কাকে বলে এবং কীভাবে ভোট দিতে হয়। তারেক রহমানের নির্দেশনায় দলের বিচক্ষণ বিদগ্ধ নেতৃত্ব প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে গেছে। দমবন্ধ পরিবেশেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তারা। তারেক রহমানের নেতৃত্ব আজ স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে শেখ হাসিনাকে খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছেন। যার ধারাবাহিকতায় ফুঁসে ওঠে জনগণ, ফুঁসে ওঠে ছাত্রসমাজ। কোটা সংস্কার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন রূপ নেয় গণবিস্ফোরণে। লাগাতার আন্দোলনে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। আশ্রয় নেন তার প্রাণপ্রিয় ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। মুক্ত হয় বাংলাদেশ, অবসান ঘটে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদি শাসনের।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনার রেঁস্তোরায় জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদী দলের গোড়াপত্তন করেছিলেন হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ ৪৫ বছরে একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক দলে রূপ নিয়েছে। এই দলটিকে ভাঙার জন্য, বিরোধ সৃষ্টির জন্য শেখ হাসিনার সরকার এমন কোন কাজ নেই যা করেনি। কখনো তৃণমূল বিএনপি কখনোবা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি। বিএনপি থেকে একটি কর্মীও ভাগিয়ে নিতে পারেনি। এখানেই শেখ হাসিনার চরম ব্যর্থতা। শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনী যত নির্যাতন, গুম, খুন, মামলা দেয় ততই নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনা বিএনপিকে ধ্বংস করতে চায়, কিন্তু বারবার সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বিএনপি বেরিয়ে আসে ফিনিক্স পাখির মতো। তারেক রহমানের পরিকল্পনায় বিএনপির নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আজ সারা বিশ্বের কাছে মডেল। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, একটি দলবাজ পুলিশ-প্রশানের বিরুদ্ধে, একটি অনুগত আদালতের বিরুদ্ধে এমন পরিকল্পিত সংগ্রাম প্রশংসা কুড়িয়েছে সর্বমহলে। আন্দোলনের এই শান্তিপূর্ণ কৌশলের কাছে ধরাশায়ী আওয়ামী লীগ নানা ফন্দি ফিকির করে এর ওপর সন্ত্রাসের তকমা লাগাতে মরিয়া। কিন্তু দেশের জনগণের কাছে আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই সন্ত্রাসী দল। 

বিগত ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে আওয়ামী লীগ নিজেরা বাসে আগুন দিয়ে, মানুষ পুড়িয়ে দোষ চাপিয়ে বিএনপিকে কোনঠাসা করেছিল। কিন্তু এবার সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এতটা শক্তিশালী ছিল না, ছিল আওয়ামী লীগের কিছু দালাল মিডিয়া। তারা এসব পরিকল্পিত হামলার শিকার মানুষকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটকে শুটিং স্পট বানিয়ে ফেলেছিল। সেখান থেকে তারা প্রতিনিয়ত বিভৎস প্রতিবেদন বানিয়ে সকল দায়-দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপিয়ে প্রচার করতো। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির ওপর জনগণের ঘৃণা সৃষ্টি করতে তারা সক্ষম হয়। সেই ঘৃণা কাটিয়ে উঠতে বিএনপির এক দশক সময় লেগে গেল।

এখন আন্দোলন হচ্ছে, পুলিশ আগের মতোই বুকে গুলি করছে, উল্টো গায়েবি মামলা দিচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা জীবন দিচ্ছে, কিন্তু পাল্টা কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না। যে কারণে বিএনপির মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে এবং বাড়ছে সমাবেশের আয়তন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে শহীদ জিয়ার হাতে গড়া বিএনপি নেতাকর্মীরা আজ দলকে এগিয়ে নিচ্ছে। এখন আন্দোলন, সংগ্রাম, রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বিএনপি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পতাকা তিন তিনবারের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে এখন তারুণ্যের প্রতীক দেশনায়ক তারেক রহমানের মুষ্টিবদ্ধ হাতে যৌবনপ্রাপ্ত।
কবি হেলাল হাফিজের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

ক্ষমতায় যতবার বিএনপি

১৯৭৮ সালের ৩ জুন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কর্নেল এমএজি ওসমানীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর বিচারপতি আবদুস সাত্তার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসাবে ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৪০টি আসন লাভের মাধ্যমে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে বিএনপি।

২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৩০০টি আসনের ১৯৩টি আসন লাভ করে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর বিএনপি নেতা জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টি আসনে জয়লাভ করে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় সংসদে ভূমিকা পালন করেছে।

পুনশ্চ, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রধান হিসেবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন।

আর গঠনতন্ত্র তৈরির জন্য ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন। তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছাড়া যুক্ত ছিলেন বিচারপতি সাত্তার, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, মওদুদ আহমদ এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী অন্যতম। প্রেসিডেন্ট জিয়া সেদিন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে নিজের নাম উল্লেখ করেন এবং জানান, কয়েকদিনের মধ্যে সদস্যবৃন্দের নাম ঘোষণা করা হবে। জন্মলগ্নে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয় ১১ জনকে। আর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে কমপক্ষে ১৫০ জন সদস্য থাকার প্রভিশন রাখা হয়।

লেখক: সাংবাদিক