রক্তাক্ত বিপ্লবের ভার এখন তারাই বহন করছেন

অন্তরবর্তী সরকারের এক মাস পূর্ণ হয়ে গেল গত ৮ সেপ্টেম্বর। এরই মধ্যে এ সরকারকে যেমন একের পর এক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে; তেমনি সামনের ষড়যন্ত্রগুলো কি হতে পারে তানিয়েও ভাবতে হচ্ছে।

যদিও অনেক হিসাবনিকাশ ইতিমধ্যে পাল্টে গেছে। তবুও বলতে হয় যে, এক অপ্রত্যাশিত গুরু দায়িত্ব এ সরকারের কাঁধে এসে পড়েছে। মূলত, একদিকে মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশার চাপ; অন্যদিকে একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের ভার বর্তেছে এই সরকারের কাঁধে।

এদিকে এটা কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয় যে, তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে বাড়ি চলে যেতে হবে। আবার এটা এমন একটা সরকার, যার অভিজ্ঞতা ছিল না এ দেশের মানুষের। কিংবা এই সরকারে উপদেষ্টা হিসাবে যারা যুক্ত হয়েছেন, তারাও আগে থেকে জানতেন না যে তাদের কি কি কাজ করতে হবে। অথবা আগে থেকে তাদের কাছে কোনো দিকনির্দেশনাও ছিল না। বরং ছাত্রজনতার উত্তাল তরঙ্গরাশি থেকে উত্থিত একটি দাবিকে সামনে নিয়ে শুরু হয়েছে এই সরকারের উপদেষ্টাদের পথচলা। আর সেটি হচ্ছে অন্যায় ও অবিচারে আচ্ছাদিত এই রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার।

কিন্তু এই রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক ভিত্তিক  এবং এর বাস্তবায়নের  পথও অনেক লম্বা,  জটিল ও  কণ্টকাকীর্ণ। বলতে পারেন এটা একটা বিপদসংকুল পথ। কারণ গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে সৃষ্ট কায়েমি স্বার্থের সুকঠিন বেড়াজাল ভেঙে একটি কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কাজ সত্যিই এক বিশাল চ্যালেঞ্জের বিষয়।

উপদেষ্টারা জেনেশুনে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেছেন। তারা এটা ভালো করে জানেন যে, যদি তারা ব্যর্থ হন; তাহলে তারাই শুধু গিলোটিনের মধ্যে পড়বেন না; বরং ১৮ কোটি মানুষের এই দেশ দুঃস্বপ্নের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে। সম্ভবত সে কারণেই তারা বহু হিসাবনিকাশ করে পা ফেলছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে, তিনটি জায়গায় দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। সেগুলো হচ্ছে- প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও পুলিশ।

কারণ ইতিমধ্যে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে: দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা কায়দায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে গণ পিটুনির মাধ্যমে হত্যার ঘটনায় সাধারণ মানুষ বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছে। যদিও একটি সফল বিপ্লবের পর এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। করণ ১৫ বছরের নিষ্ঠুর শাসনে নিষ্পেষিত অনেকে প্রতিশোধ নিতে চাইবে। কিন্তু সরকার গঠনের এক মাস পর আইনের শাসনই সবার কাম্য।

পাঠক, ফরাসি বিপ্লব উত্তর যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন বিপ্লবের নেতা রবেশপেয়ারে। যার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সে আবার কর্তৃত্ববাদ ফিরে আসে। কিন্তু বাংলাদেশের   ক্ষেত্রে আশার কথা হচ্ছে, ফরাসি বিপ্লবের নেতা ছিলেন প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষী; কিন্তু আমাদের নেতা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতালোভী ও উচ্চাভিলাষী নন। তাকে এ দেশের আপামর মানুষ ভালোবাসায়, আস্থায় আপন করে নিয়েছেন।

তবে বর্তমান সরকারের  মূল সমস্যা হবে দ্রুততম সময়ে বাঙালির স্বপ্ন পূরণ করা। কারণ বাঙালির মধ্যে তাড়াহুড়োর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সে যা চায় তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পেতে চায়। আর  তা না পেলে হয় সে হতাশ হয়ে পড়ে, না হয় তা পাওয়ার জন্য বৈধ-অবৈধ যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে সামান্য দ্বিধা করে না। হয়তো সে কারণেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 'মানুষ অত্যন্ত তাড়াহুড়ো প্রবণ'।

সম্ভবত বাঙালি এ ক্ষেত্রে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে। তারা তখনই ধৈর্যশীল হন, যখন দেখেন আর কোনো উপায়ন্তর নেই। কিন্তু যখন সুযোগ আসে তখন তাদের তাড়াহুড়ো ও প্রতিযোগিতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে।

অথচ তাড়াতাড়ি সব কিছু পাওয়ার এ প্রবণতা মানুষের জীবনের কত সম্ভাবনাকে যে ধ্বংস করে দিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। সে কারণেই হয়তো আল্লাহ পাক বলেছেন, তিনি 'ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন'। অন্যদিকে রাসুল (সা:) বলেছেন, ধৈর্য ও স্থিরতা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর তাড়াহুড়ো শয়তানের পক্ষ থেকে'।

সুতরাং বিপ্লব উত্তর বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে সকল মহলকেই ধৈর্যের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সে কারণেই হয়তো প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার প্রথম ভাষণেও সেই ধৈর্য ধারণের কথাই বলেছেন। কিন্তু সব কিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, একটা রক্তাক্ত রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মানুষ যেন চরমভাবে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে।

তারা সব কিছু পেতে উগ্র মনোভাব পোষণ করছে। ভাবখানা এমন যে, অন্তরবর্তী সরকারের হাতে জাদুর কাঠি আছে, তা দিয়ে রাতারাতি সব কিছু করে ফেলতে পারবে। কিন্তু ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী অপশাসনে সৃষ্ট আকাশ ছোঁয়া সমস্যাগুলো কি ১৫ দিনেই সমাধান করা সম্ভব?

পাঠক এখন এ সত্য উপলব্ধি করতেই হবে যে, বিগত ১৫ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর ফ্যাসিবাদী শাসনে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। বলা যায় একটি আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রকে অষ্টাদশ কিংবা উনিশ শতকের জমিদারি প্রথায় পর্যবসিত করা হয়েছিল। এখন এ থেকে উত্তরণের পথ দেখানোই অন্তবর্তী সরকারের প্রধান কাজ।