হতাশার বিপরীতে আশার আলো ছড়াতে হবে সরকারকে

৮ আগস্ট সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একশ দিন হলো আজ (১৫ নভেম্বর)।  ৮ আগস্ট সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই তারিখে শপথ নিয়েছিলেন আরও কয়েকজন উপদেষ্টা। এরপর ধাপে ধাপে আরও কয়েকজন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন।

বাংলাদেশে সরকার গঠনের পর একশ’ দিনের একটা কর্মসূচি ঘোষণা করার অলিখিত একটি প্রথা রয়েছে। সরকারের প্রথম একশ’ দিনের এই সময়টাকে কেউ কেউ মধুচন্দ্রিমা কাল বলেও উল্লেখ করেন। এই একশ’ দিনে সরকারের কাছে মানুষের খুব একটা প্রত্যাশার চাপ থাকে না। এ সময়টাতে সরকার উড়ে বেড়ায়, মন্ত্রীরা ঘুরে বেড়ান। ঘুরে বেড়ান মানে তারা এ সময়টাতে দেখে দেখে শেখেন। আবার এই একশ’ দিনই সরকারের কাছে অনেক চ্যালেঞ্জিং, কারণ এ সময়টাতেই তারা জনগণকে নানা চমক দেখান, আচার-আচরণে, কাজে-কর্মে। 

একশ’ দিনে সরকারকে মানুষ নিক্তিতে ওঠায় না, তবে মানুষ বুঝে নেয় সরকার কেমন করবে, কতটা পারবে, অনেকটা ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ বা ‘সকালটাই বলে দিনটা কেমন যাবে’ ধরনের ব্ষিয়।  রাজনৈতিক সরকারের একশ’ দিন হেসে খেলে যায়। নানাবিধ আনন্দমুখর কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডে তারা মানুষকে মাতিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। মন্ত্রীরা তাদের কথা আর কাজ দুটো দিয়েই মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেন।

এ কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্রান্তিকালের সরকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।  কিছু পলাতক রাজনৈতিক দল বাদে সব দল এই সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। দেশের মানুষ তাদের হৃদয়ের সব ভালোবাসা দিয়ে এই সরকারের পাশে রয়েছে। একশতম দিনে এসে মানুষ এই সরকারের সূচনাটা কেমন হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করছে। 

একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় আসে তারা একটি ইশতেহার বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে আসে। তাদের নানা মেয়াদি কর্মসূচি থাকে। তারা কি করবে আর করতে চায় তা সবিস্তারে থাকে ইশতেহারে। বাস্তবিক কারণেই এই সরকারের না আছে কোন ইশতেহার, না আছে কোন ধরনের মেয়াদভিত্তিক কর্মসূচি।  তবে এই সরকার একটি একশ’ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারতো। আমি মনে করি এখনো পারে।  বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে ঘোষণা করা যায় এই সরকারের একশ’দিনের কর্মসূচি।  এই কর্মসূচি সর্বমহলে বিবেচিত হতে পারে সরকারের প্রাথমিক রোডম্যাপ হিসেবে।

যাই হোক, সরকারের পার হয়ে আসা শতদিন  প্রসঙ্গে আসি। এই দিনগুলোতে সরকার কতটা জায়গা করে নিতে পেরেছে মানুষের মাঝে? মানুষের যে আস্থা, আশা আর বিশ্বাস ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি তার কতটা পূরণ করতে পেরেছে সরকার?  মানুষের আস্থা আর বিশ্বাস  এখন কতটুকু আছে তা সরকারকে জানতে হবে এবং তা নিয়ে ভাবতে হবে।

এ কথা ঠিক যে মোটাদাগে এ সরকারের সাফল্য চোখে পড়বে না।  বাংলাদেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত না হলেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন কার্যত একটি যুদ্ধই ছিল। জনগণের বিপক্ষে সরকারের যুদ্ধ। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় হাসিনা সরকার। তার পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে জাতি একটি ভয়ংকর শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ক্ষমতা নিল, কিন্তু অগোছালো প্রশাসন, ভঙ্গুর পুলিশি ব্যবস্থা, শূন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, নাজুক অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক করতে নানা মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্ররোচনামূলক নানা কর্মকাণ্ড।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সব সময়ই একটি কঠিন কর্ম। শেখ হাসিনা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, এই ১৬ বছরে কখনোই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ছিল না বরং কখনো কখনো তা কল্পনাতীতভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পেঁয়াজের কেজি চারশ’ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। আগের সরকারের ব্যর্থতা পরের সরকারের কাছে সন্তুষ্টির বা প্রবোধের কারণ হতে পারে না, বড়জোর তা থেকে শেখার বিষয় হতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন উপদেষ্টা এসেছেন, দেখা যাক ব্যবসার ক্ষেত্রে সফল এই উপদেষ্টা জনগণের জন্য সরাসরি কাজ করার ক্ষেত্রে কতটা সফল হন।

একশ’ দিনে রাজনৈতিক ইস্যুগুলো সরকার ভালভাবেই সামাল দিতে পেরেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তারা একটি রোডম্যাপ চান। রোডম্যাপ হয়তো এখনই দেয়া সম্ভব নয়, তবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন উপলব্ধি করে নির্বাচন আয়োজনে সরকারের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ রয়েছে সে মত সরকারকে কাজ করতে হবে। সংবিধান, প্রশাসন, পুলিশ, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় সংস্কারে যে সব কমিশন গঠিত হয়েছে, সে সব কমিশনের কাজ কর্মও স্পষ্ট নয়। মানুষের কাছে তাদের কাজগুলো তুলে ধরতে হবে।

সরকার একটি কাঠামো, কিন্তু মানুষই তো সরকার পরিচালনা করে। তাদের কাজ বুঝতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখনো ভুল হয়, কখনো ঠিক হয়। কিন্তু কাজ করতে হয়। সেদিক বিবেচনায় এ সরকারের প্রথম তিন মাসকে সফল বা ব্যর্থ কোনটাই বলা যায় না। তবে এই সরকার যা করেছে তা অনেকটা অন্তরালেই রয়ে গেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে অনুধাবন করতে হবে যে, প্রচারসর্বস্ব এর বিপরীত অবস্থান প্রচারবিমুখ হতে পারে কিন্তু প্রচারহীনতা নয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী ব্যক্তি। বিদেশে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, দেশের মানুষ এখনো তার ব্যাপারে হতাশ নয়, তবে হতাশা ছড়ানোর নানামুখী চেষ্টা আছে। তা থেকে দেশ আর মানুষকে রক্ষা করাটাও সরকারের দায়িত্ব। পূর্ণোদ্যমে, পূর্ণগতিতে প্রবাহিত হোক এ সরকারের কর্মকাণ্ড। হতাশার বিপরীতে আশার আলো দেখানোটাও সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন