সাত কলেজ সমস্যা, নতুন কিছু ভাবুন

দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে রাজধানীর সাত কলেজ সমস্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বাংলা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে থাকতে চায় না। থাকতে চায় না, মানে থাকার মতো পরিবেশ নেই।

শিক্ষার মান উন্নয়নে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু মান উন্নয়ন তো দূরের কথা, শিক্ষা জীবনটা নির্বিঘ্নে শেষ করতে এখন নিয়মিত রাজপথে থাকতে হচ্ছে এই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামর্থ্য বা সক্ষমতার দিকে না তাকিয়ে বিষয়টাকে তাদের মর্যাদার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। সরকারও এ বিষয়ে খাবি খাচ্ছে, অনেকটা কূল রাখি না শ্যাম রাখি অবস্থা।

কিন্তু এ সমস্যাটির সাথে প্রায় দেড় লাখ তরুণ-তরুণীর উচ্চ শিক্ষার প্রশ্ন জড়িত। বিষয়টাকে গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। এই সমস্যার সমাধান খুব দ্রুত করা দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে বড় বড় সংস্কারে হাত দিয়েছে, সে তুলনায় এটি তো ছোট একটি সমস্যা। অবশ্য গুরুত্বের বিচারে এটি বেশ বড় সমস্যা। তাই এর সমাধানে সরকারকে ভাবতে হবে একটু বিস্তৃতভাবে।

সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এ সংকট সমাধানে এবার সরকার বেশ সক্রিয়। সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেখে করলে এর সমাধান সহজেই করা যায়। এ জন্য কোন আলাদিনের চেরাগের দরকার নেই। রাজধানীর যে কোন একটি স্থানে ১০ তলা ভবন করে তার একেক তলায় একেক কলেজের বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। ওই ভবনেরই একটি ফ্লোরে ‘কমন’ কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে কাজ আর কঠিন থাকে না।

পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রো-ভিসিকে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তার জন্য অন্য কোন পদ সৃষ্টির দরকার নেই। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসির পদ আরেকটি বাড়িয়ে তার দায়িত্ব (বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষা) উল্লেখ করলেই চলে। সাত কলেজের অধ্যক্ষগণ পদাধিকার বলে সাত কলেজ পরিচালনা বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য হবেন, পাশাপাশি থাকতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন প্রতিনিধি ও শিক্ষক প্রতিনিধি।

এই পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের সাথে কোন রকম সংশ্লিষ্টরা ছাড়াই সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবর্ষ, পরীক্ষা, ফলাফল ও সনদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ নাও হতে পারে। যদি এই কলেজগুলোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ কমলা রঙের হয়, এক সময় দেখা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সনদের চেয়ে কমলা রঙা সনদই বেশি গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তাদের সবকিছু আলাদা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয় নিয়েই নিজেদের স্বতন্ত্র স্বত্ত্বাকে গৌরবান্বিত করতে বেশি প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করবে এই কলেজগুলো।

এর পাশাপাশি আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও ভাবা যায়। এই সাত কলেজের পাশাপাশি খুলনার বিএল কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ, ময়মনসিংহের এমএম কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজ, মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ, মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ, গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম কলেজ, বরিশালের সরকারি গৌরনদী কলেজ এবং এমন ধরনের আরও কিছু কলেজ নিয়ে হতে পারে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়।

এই কলেজগুলোর রয়েছে অবকাঠামোগত বিশালতা, রয়েছে ক্যাম্পাসের অবস্থানগত বৈচিত্র্য। আর ইতিহাস ও ঐতিহ্যে তো এই কলেজগুলো দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে অতুলনীয় অবস্থানে আছে। দেশের সব বড় কলেজকে একই ছাতার নিচে আনা শুধু দেশের একটি সমস্যার সমাধান করবে না, দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন প্রাণপ্রবাহ তৈরি করবে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন একটি নাম দেয়া যায় যা একই সাথে ঐতিহ্য আর আধুনিকতাকে ধারণ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ‘ঐতিহ্য বিশ্ববিদ্যালয়’ দেয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বা বহির্বিশ্বে এর সনদকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে এর ইংরেজি নামকরণ করা যেতে পারে ‘The University of Heritage’।

সাত কলেজসহ দেশের ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলো স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হলে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজকে বের করে আনার সম্মানজন ‘এক্সিট রুট' তৈরি করবে। পাশাপাশি অন্য যে কলেজগুলোর কথা বলা হয়েছে তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে এলে অনেকটা চাপ মুক্ত হবে দেশের সর্ববৃহৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়টিও।

সাত কলেজ সমস্যাটিকে হালকা করে দেখা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানে একাধিক কমিটি কাজ করছে। জানি না তারা বিষয়টাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবেচনা করছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, কোন গতানুগতিক চিন্তা-ভাবনা নয়, এ সমস্যার সমাধান করতে হলে বৈপ্লবিক চিন্তাই করতে হবে, সিদ্ধান্তটা হতে হবে যুগান্তকারী।

লেখক: আব্দুর রহমান, সাংবাদিক