জাকসুর অনুপস্থিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরতান্ত্রিক যাত্রা

ছবি : দ্য মিরর এশিয়া

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন, যা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দেয়। সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে এবং ১৯৯৩ সালে এর বিলুপ্তির পর থেকে ক্যাম্পাস একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবে ভুগছে। জাকসু ছাড়া শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন, যার মধ্যে উপাচার্য নির্বাচনও অন্তর্ভুক্ত; যা গণতান্ত্রিক নীতিমালা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধান উভয়কেই লঙ্ঘন করে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ বিনষ্ট করে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদে শিক্ষার্থীদের মতামত পৌঁছে দেওয়ার বৈধ প্লাটফর্ম হলো জাকসু। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পর্ষদ সিনেটে পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকে জাকসু থেকে। জাকসু না থাকায় শিক্ষার্থীরা তাদের মূল প্ল্যাটফর্মটি হারিয়েছে, যা ক্যাম্পাসে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রভাব অনুভব করছে, কারণ গণতান্ত্রিক কাঠামোর অভাবে প্রশাসনের কর্তৃত্ব এবং রাজনীতিকরণ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চর্চায়ও ব্যাঘাত ঘটেছে, যার সুযোগ নিয়েছে ছাত্রলীগের মতো সংগঠন। সারা দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের দাপট ও নানা অনিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ের পরিবেশ। শিক্ষার্থীরাও রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে।

১৯৯৩ সালে জাকসুর বিলুপ্তির পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করেছে, যা প্রায়শই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের সমর্থন পেয়েছে। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অভাব শিক্ষক ও প্রশাসনিক নিয়োগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করেছে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ এবং ডিনের মতো পদে যোগ্যতার থেকে বেশি বিবেচিত হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুগত্য। তারা পদে আসীন হওয়ার পর শিক্ষা সংশ্লিষ্ট উন্নয়নের থেকে ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও তাদের রাজনৈতিক সতীর্থদের স্বার্থ রক্ষায়ই সচেষ্ট থেকেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব বিশ্ববিদ্যালয়কে লুটপাট এবং ক্ষমতাচর্চার অঙ্গনে পরিণত করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থতিতেও যদি জাকসু নির্বাচন না হয়, তাহলে ভিন্ন চেহারায় আবারও ভয়ের পরিবেশ, লুটপাটের পরিবেশ ফিরে আসবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন প্রশাসনিক নিয়োগ সে বার্তাই দিচ্ছে।

এই রাজনীতিক পরিবেশের প্রভাব গভীর। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো প্রভাব পালা করে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করেছে, যা প্রায়ই ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। তারা আবাসিক হলগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, যেখানে হল প্রশাসন কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে সে সময়ে। র‍্যাগিং, সিট বাণিজ্য, কৃত্রিম সিট সংকট তৈরি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নারী নিপীড়নসহ নানা অপকর্মে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ নষ্ট করা হয়। রাজনৈতিক তল্পিবাহক প্রশাসনের নির্লজ্জ সমর্থন ও অপকর্মের অংশীদার হওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, যা দুই বিতর্কিত উপাচার্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল; অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির এবং অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। অধ্যাপক শরীফের মেয়াদকাল শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মাধ্যমে তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। আর অধ্যাপক ফারজানা ব্যাপক ছাত্র ও শিক্ষক আন্দোলনের সম্মুখীন হয়েছিলেন। দিনের আলোয় ছাত্রলীগ দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন করা সত্ত্বেও তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্লজ্জ সমর্থনে তার পদ ধরে রাখতে সক্ষম হন।

এছাড়া বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের আক্রমণ এবং মারাত্মকভাবে প্রহার করে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয় নীরব থাকে অথবা প্রকাশ্যে তাদের পক্ষ নেয়। এই কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতি, যা জাকসুর অনুপস্থিতিতে বাড়তে পেরেছে, জাকসু থাকলে ছাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংগঠনগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো এবং তাদের সহিংস ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও, জাকসুর অনুপস্থিতি শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রশাসনে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব না থাকায় শিক্ষকেরা খুব কম জবাবদিহিতার সম্মুখীন হন। কিছু বিভাগে স্বৈরাচারী এবং স্বজনপ্রিয়তা অনুশীলন সাধারণ হয়ে উঠেছে এবং শিক্ষার্থীরা প্রায়ই প্রতিবাদ করতে ভয় পায়; পাছে তারা শিক্ষকদের প্রতিহিংসার সম্মুখীন হয়। জাকসুর অনুপস্থিতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিক এবং কর্তৃত্ববাদী প্রভাবের প্রতি অরক্ষিত করে তুলেছে, যা প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক ও একাডেমিক অখণ্ডতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জাকসু পুনর্বহাল করা একটি ভারসাম্যপূর্ণ, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতাপূর্ণ ক্যাম্পাস পরিবেশ পুনরুদ্ধার করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ গঠনে তাদের কণ্ঠ পুনরুদ্ধার করতে পারবে।

সর্বশেষে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাকসুর অনুপস্থিতি কর্তৃত্ববাদী কার্যকলাপের জন্য একটি উর্বর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং একাডেমিক অখণ্ডতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জাকসু পুনর্বহাল করা কেবল শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়িত করবে না, বরং ক্যাম্পাসে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণের সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে, যা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার মূল মূল্যবোধ এবং মিশনের সাথে পুনরায় সামঞ্জস্য করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়