জুলাই হত্যাকাণ্ড যেভাবে জেনোসাইডের সংজ্ঞাকে পূরণ করে

সংগৃহীত ছবি

গণহত্যা বা জেনোসাইড শব্দটি পোলিশ আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে উদ্ভাবন করলেও এর বিষয়বস্তুকে ঘিরে তাত্ত্বিক ও আইনি বিতর্ক আজ পর্যন্ত চলমান। অসংখ্য গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ তাদের কাজের মাধ্যমে বারবার দেখিয়েছেন ‘গণহত্যা’ শুধু জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বরং ক্ষমতাসীন কোনো গোষ্ঠী যখন পরিকল্পিতভাবে অন্য কোনো গোষ্ঠীকে (রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্যও হতে পারে) নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নেয়, তখনও তা গণহত্যার পর্যায়ে পড়তে পারে।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটালো আওয়ামী লীগ, তাকে জেনোসাইড বলা যাবে কি না— এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। সেই বিতর্কে একটু আলোকপাত করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। 

আমি বলতে চাই জেনোসাইডের সংজ্ঞাকে আমরা জাতিসংঘের যেই ফ্রেমে বেঁধে ফেলতে পছন্দ করি, খোদ জেনোসাইড শব্দের প্রবক্তার প্রচেষ্টার সাথেই তা সাংঘর্ষিক।

পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই সংজ্ঞা নিয়ে একাডেমিক পরিসরে যেই পরিমাণ বিতর্ক হয়েছে সেটাকে আমলে না নিয়ে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে চালানো এই হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত সংজ্ঞায়ন আমরা করতে পারবো না।

আমরা অনেকেই জানি, রাজনৈতিক নিপীড়ন ‘গণহত্যা’ হিসেবে গণ্য হতে পারে কি না—এই প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক আছে। রাফায়েল লেমকিন যখন জেনোসাইড শব্দটি প্রথম উদ্ভাবন করেন, তখন তিনি কেবল জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর নির্যাতনকেই গণ্য করেননি, বরং রাজনৈতিক বা অন্য কোনো গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসকেও গণহত্যার মধ্যে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের সময় সোভিয়ত ইউনিয়নের মতো বড় রাষ্ট্রগুলোর চাপ ও স্বার্থের কারণে ‘রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত নিপীড়ন’ শব্দগুলোকে সংজ্ঞা থেকে বাদ পড়ে। ফলত আজও কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ আইনগতভাবে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বেশ বেগ পেতে হয়।

এই কারণে শুধু যে চব্বিশের ঘটনার সঠিক সংজ্ঞায়ন করা যাচ্ছে না তা-ই না, বসনিয়া, কম্বোডিয়া, মায়ানমারের স্পষ্ট জেনোসাইডের ঘটনাগুলোকেও জাতিসংঘ এড্রেস করে না। কারণ সবখানেই ক্ষমতাসীন নিপীড়কেরা যাদের হত্যা করছে তাদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা সন্ত্রাসী ইত্যাদি বর্গে অন্তর্ভুক্ত করে নিজেদের দায়মুক্ত করতে চাচ্ছে। কিন্তু রাফায়েল লেমকিনের মূল ভাবনা কিংবা আধুনিক গবেষকদের সংজ্ঞার আলোকে এটা একেবারে স্পষ্টরুপে প্রতীয়মান হয়, ক্ষমতাসীনদের হাতে তার বিরুদ্ধমতের রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিধনও গণহত্যার চরম রূপ হতে পারে।

এই প্রবন্ধে আমরা প্রথমে জুলাই আগস্টের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করবো, এরপর আধুনিক গবেষক ও বিশ্লেষকের দেওয়া জেনোসাইডের সংজ্ঞার সাথে জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে চলা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করবো। এরপর গ্রেগরি স্ট্যান্টনের বিখ্যাত ‘এইট স্টেইজেস অব জেনোসাইড’ মডেলে দেখব, কীভাবে এসব ধাপের সঙ্গে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে (জুলাই-আগস্ট) ঘটে যাওয়া রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হত্যাকাণ্ডের আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

পটভূমি : কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য সংরক্ষণমূলক কোটা নিয়ে বিতর্ক বহু বছরের। ২০১৮ সালে সীমিত সংস্কার হলেও ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ‘৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল’ করে একটি রায় দিলে ছাত্র-জনতার মধ্যে অসন্তোষ ছড়ায়। ছাত্ররা মনে করে, স্বচ্ছ নিয়োগ ও মেধার মূল্যায়নের পথে এটি নতুন বাধা সৃষ্টি করবে। তাছাড়া রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অনুসারী নিয়োগের সুযোগ পাবে। শুরুতে এই বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের ধারায় এগোচ্ছিল। কিন্তু জুলাইয়ের শুরুর দিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ পরিস্থিতিকে উত্তাল করে। ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে সহিংসতার মাত্রা বাড়তে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, রামপুরা, এমনকি চট্টগ্রামেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের  সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এই পর্যায়েই নির্দিষ্ট নির্দেশে “গুলি চালানো”র মাত্রা বাড়তে শুরু করে।

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে অসংখ্য শিক্ষার্থী নিহত ও আহত হতে থাকলে, বিক্ষোভকারীরা কেবল কোটাবিরোধী অবস্থানে আটকে থাকেননি। অনেক বিরোধীদলীয় কর্মী এবং নাগরিক সমাজের বড় অংশও এই বিক্ষোভে যোগ দেয়। ক্রমে এটি সরকার পতনের আন্দোলন রূপ নেয়। দাবি ওঠে, “বর্তমান সরকার জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে এবং দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে জনগণের অধিকার হরণ করছে”—তাদের অপসারণ অপরিহার্য। জুলাইজুড়ে বিক্ষোভের তীব্রতা এমন পর্যায়ে যায় যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন। কিন্তু ইতোমধ্যে দেশজুড়ে হাজারের অধিক মানুষ নিহত ও আহত হন।

এই আন্দোলনে প্রায় ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। অন্যদিকে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক সূত্র ও কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই সংখ্যা দুই হাজার বা তার চেয়েও বেশি বলে উল্লেখ করেছে।

জাতিসংঘ একটি প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধান করে পায়— 
*এই সহিংসতায় ১৪০০-এর মতো মানুষ নিহত হতে পারে 
*নিহতদের মধ্যে প্রায় ১২-১৩% শিশু ছিল।
* `বিরাট অংশকে লক্ষ করে পরিকল্পিত গুলি চালানো,' যার বড় প্রমাণ—ওপর থেকে নির্দেশিত মিলে পুলিশের, র‍্যাবের ও বিজিবির যৌথ সক্রিয় অংশগ্রহণ।
*জুলাই-আগস্টে প্রায় ১১,৭০০ জন গ্রেপ্তার হন, এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক তরুণ ও ছাত্র ছিলেন।

জাতিসংঘ আরও জানায়, এই সহিংসতায় অংশ নেওয়া রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ ছিল “প্রয়োজনবোধে গুলি করে” আন্দোলন দমিয়ে রাখার, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নারীদের ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন, শিশুদের ক্ষেত্রেও হত্যাকাণ্ড ও আটক, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে তথ্য প্রবাহ বন্ধ ইত্যাদিও ঘটে।

জেনোসাইডের তাত্ত্বিক পরিমাপ : কেন জুলাই-আগস্টের ঘটনাকে গণহত্যা বলা যেতে পারে?

জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের সনদে জাতিগত, ধর্মীয়, জাতীয়, বর্ণগত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সিস্টেমেটিক ধ্বংসযজ্ঞকে গণহত্যা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় মদদে সিস্টেমেটিক কিলিংয়ের কথা সেখানে নেই। 
ফলে আইনগতভাবে সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক নিধনকে সরাসরি জেনোসাইড হিসেবে অভিহিত করা কঠিন। তবু, রাফায়েল লেমকিনের মৌলিক ধ্যানধারণায় ও পরবর্তী ৭৫ বছরে অসংখ্য গবেষকের সংজ্ঞায় ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠী’কে পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগকেও জেনোসাইডের পর্যায়ে ফেলা হয়েছে।

আমরা আধুনিক সময়ের কয়েকজন গবেষকের আলাপ থেকে দেখবো জুলাই-আগস্ট (২০২৪) সময়ে আন্দোলনকারীদের ওপর যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা একেকটি সংজ্ঞার সঙ্গে স্পষ্ট মিল রেখে ‘রাজনৈতিক গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে কি না? গবেষক ইরভিং লুই হরোউইটজ (১৯৭৬) রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে ব্যাবহার করে নিরপরাধদের ধ্বংস করা হলে সেই কাণ্ডকে গণহত্যা বলেছেন। বাংলাদেশে পুলিশ-র‍্যাবের মতো সংস্থাগুলো এ ধরনের কাঠামোগত ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত ছিল।

সংঘাত গবেষক পিয়েতার এন. ড্রস্ট (১৯৫৯) উল্লেখ করেন, ‘কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণেই যদি তাদেরকে হত্যা করা হয়, সেটি গণহত্যা’। চব্বিশে বিরোধী ছাত্র, বিরোধী দল, সরকারের সাথে অমত করা, লাল প্রোফাইল পিকচার দেওয়ার মতো পরিচয়কে রাষ্ট্রের টার্গেট করেছিল, ফলে এটাও গণহত্যা হিসেবে বিচার্য।

থমাস আর্ল পোর্টার (২০২৪) বলেছেন, ‘গণহত্যা ঘটে যখন কোনো গোষ্ঠীর সামাজিক বন্ধন ভেঙে দেওয়া হয়’। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোটাবিরোধী ও সরকারবিরোধী ছাত্রদের ঐক্য ভাঙতে নির্বিচারে গুম, গুলিবর্ষণ, ধরপাকড় করা হয়েছে। 

তাত্ত্বিক নেহেমিয়াহ রবিনসন (১৯৬০) বলেন, ‘নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ড চালালে তা গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে’।সরকার ‘আন্দোলনকারী ছাত্র’ পরিচয়কে চিহ্নিত করে নির্বিচারে নিপীড়ন করেছে ফলে এটাও গণহত্যা।

প্রখ্যাত গবেষক টনি বার্টা (১৯৮৭) বলেন, ‘গণহত্যামূলক সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো আনুষ্ঠানিকভাবে “নিরাপত্তার” নামে বাস্তবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো’। বাংলাদেশে সরকার ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা’র কথা বলেও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

গবেষক জ্যাক নুসান পোর্টার (১৯৮২) রাজনৈতিক সংখ্যালঘু নিঃশেষের চেষ্টা করলে সেটিকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এখানে কোটাবিরোধী বা বিরোধী মতালম্বী ছাত্রগোষ্ঠী ক্ষমতার বিচারে ‘সংখ্যালঘু’ এবং রাষ্ট্র পরিকল্পিতভাবে তাদের টার্গেট করে।

হেনরি হুটেনবাখ (১৯৮৮) সেই ধরনের যে কোনো কর্মকে গণহত্যা বলছেন যা কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্বকেই হুমকিতে ফেলে। চব্বিশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং পুলিশের বর্বর গুলি ও নিপীড়নে এই আন্দোলনকারী গোষ্ঠী একপ্রকার নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল।

ফ্র্যাঙ্ক চাল্ক ও কার্ট জোনাসোন (১৯৯০) একতরফাভাবে হত্যা ও গোষ্ঠী ধ্বংসের অভিপ্রায়কে গণহত্যা বলেছেন। চব্বিশে আমরা দেখেছি রাষ্ট্র ও দলীয় ক্যাডাররা সশস্ত্র ছিল, পক্ষান্তরে বিক্ষোভকারীদের ভারী অস্ত্র ছিল না, রাষ্ট্র সবাইকেই হত্যা করতে চেয়েছিল এবং সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ফোনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তেমন নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলে প্রমাণ মেলে।

স্টিভেন টি. ক্যাট্‌জ (১৯৯৪) বলেন, ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নিঃশেষের উদ্দেশ্য থাকলে তা গণহত্যা’। চব্বিশেও সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘সমূলে দমন’ করার লক্ষ্যে সহিংসতা করেছে তা স্পষ্ট।

ইস্রায়েল ডবলিউ. চার্নি (১৯৯৪) বলেছেন, ‘নিরুপায় জনগোষ্ঠীর ওপর গণহারে হত্যাকেই গণহত্যা বলা যায়’। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা সশস্ত্র ছিল না, অথচ তাদের ওপর ব্যাপক গোলাগুলি করা হয়েছে।

বারবারা হার্ফ (২০০৩) “Genocide ও Politicide” প্রসঙ্গে বলেছেন যে “governing elites” কোনো গোষ্ঠীকে ধ্বংসের নীতি নিলে তা গণহত্যা। আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে বিরোধী ছাত্রদের ধ্বংসে নেমেছে সুতরাং চব্বিশের ঘটনাও গণহত্যা।

মার্ক লেভিন (২০০৫) দেখিয়েছেন, রাষ্ট্র যখন বড় কোনো জনসম্প্রদায়কে হুমকি মনে করে নিশ্চিহ্ন করে, তখনই গণহত্যা সংঘটিত হয়। চব্বিশে আওয়ামী লীগ সরকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে প্রধান হুমকি দেখেছিল।

গবেষক জ্যাকস সেমেলাঁ (২০০৫) অসামরিক গোষ্ঠীকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়াকে গণহত্যা বলেছেন। আমরা দেখেছি জুলাই-আগস্টে শহরজুড়ে শিক্ষার্থীদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে সিস্টেমেটিক দমন-অভিযান চলেছে।

ড্যানিয়েল চিরোট ও ক্লার্ক ম্যাককলি (২০০৬) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গণহারে হত্যাকে গণহত্যা বলেছেন। বাংলাদেশের ঘটনায়ও সরাসরি ‘সরকারবিরোধী’ বলে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

ড্যানিয়েল ফেয়ারস্টাইন (২০০৭) বৃহৎ পরিসরে ও পদ্ধতিগত পরিকল্পনায় একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে ধ্বংসের পায়তারে গণহত্যা বলেছেন। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সরকার মাসব্যাপী আক্রমণ-পরিকল্পনা করে দমন অভিযান চালায়। 

ডোনাল্ড ব্লক্সহ্যাম (২০০৯) কোনো গোষ্ঠীর বড় অংশের শারীরিক নিশ্চিহ্নকরণকে গণহত্যা বলেছেন। বাংলাদেশে একাধিক সূত্রে শত শত বা হাজারের ওপর মানুষ নিহত হয়েছে।

উগুর উমিত উঙ্গর (২০১১) বলেছেন, ‘কোনো গোষ্ঠীর সদস্য বলে ধরে নিয়ে ধারাবাহিক নিপীড়ন-হত্যাই গণহত্যা’। বাংলাদেশে সেই সময়ের সরকার বিরোধী বা ছাত্র পরিচয়েই অনেককে ধরে নিপীড়ন করা হয়েছে। উঁচু পর্যায়ের সরকারি সিদ্ধান্তে র‍্যাব, বিজিবি, পুলিশ সক্রিয়ভাবে এই নিধনযজ্ঞে ভূমিকা নিয়েছিল।

এই সবগুলো সংজ্ঞায় সরাসরি বা পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে—‘রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীকে’ পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করার কোনো পদক্ষেপ গণহত্যার আওতায় পড়তে পারে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার যে মাত্রায় সহিংসতা চালিয়েছে—বিরোধীদল, সাধারণ আন্দোলনকারী, জনতা ও কোটা-বিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে সেটিকে তাই নিঃসন্দেহে জেনোসাইড বলতে পারা উচিত।

স্ট্যান্টনের “Eight Stages of Genocide” ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

গবেষক গ্রেগরি স্ট্যান্টন গণহত্যার আটটি ধাপের কথা উল্লেখ করেন: Classification, Symbolization, Dehumanization, Organization, Polarization, Preparation, Extermination, Denial। এই আটটি ধাপ বাস্তবায়ন করা হলে সেই ঘটনাকে জেনোসাইড বলা যাবে। ২০২৪ সালের বাংলাদেশে এগুলো একে একে দেখা গেছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন :

১. ক্লাসিফিকেশন বা বিভাজন : সরকার ও ক্ষমতাসীনদের ভাষায়, ‘সরকারপন্থী বনাম সরকারবিরোধী,’ ‘দেশপ্রেমিক বনাম রাজাকার,’ ইত্যাদি তকমা দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিরোধিতা করলেই পূর্ণাঙ্গ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

২. সিম্বলাইজেশন (প্রতীকায়ন) : সরকারের বিরোধিতা করা ছাত্রদের ‘উগ্র জঙ্গি,’ ‘শিবির,’ ‘রাজাকার-পরবর্তী প্রজন্ম’ ইত্যাদি বলে ডাকানো, তাদের ওপর বিশেষ ট্যাগ প্রয়োগ করা হয়েছে। সরকারপন্থীরা কালো রং বেছে নিয়ে আন্দোলনকারীদের লাল রংকে আক্রমণ করেছে।

৩. ডিহিউম্যানাইজেশন (অমানবিকীকরণ) : শিক্ষার্থীদের ‘নাশকতাকারী কীট,’ ‘রাষ্ট্রের দুশমন’ বলে দেখানো, যাতে হত্যা করা ন্যায়সংগত ঠেকে।

৪. অর্গানাইজেশন (সংগঠিত করা) : পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবির পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগকে মাঠে নামিয়ে পরিকল্পিত হামলা। সারা দেশে সামরিক ধাঁচের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

৫. পোলারাইজেশন (মেরুকরণ) : ‘তোমরা হয় আমাদের পক্ষে, নয় শত্রু’ ধরনের বক্তৃতা, সামাজিক মিডিয়ায় বিদ্বেষ, গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকারীদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।

৬. প্রিপারেশন (প্রস্তুতি) : ইন্টারনেট শাটডাউন, অবাধ গ্রেপ্তার, সাদা পোশাকের গোয়েন্দা তৎপরতা ইত্যাদি, যেন একযোগে হামলা চালানো যায়।

৭. এক্সট্রিমিনেশন (বিনাশ) : নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, গুম, যথেচ্ছ হত্যা— জাতিসংঘের তথ্যমতে হাজারের বেশি লোকের জীবনহানি। এটি ‘গণহারে ফিনিশিং’ পর্যায়।

৮. ডিনায়াল (অস্বীকার) : তৎকালীন সরকারের বক্তৃতায় প্রথমে মৃত্যু সংখ্যা কমিয়ে বলা, শত্রু পক্ষের ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেওয়া, ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে চিত্রিত করা। এখন পর্যন্ত সরকারপন্থী এক্টিভিস্টদের অনলাইনে সক্রিয়ভাবে হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করে যাওয়া, একে ষড়যন্ত্র বলা, সবই ডিনায়ালের অংশ।

এগুলোকে মিলিয়ে দেখলে প্রতীয়মান হয়, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মূলত এই আট ধাপ স্পষ্টভাবে অনুসরণ করেছে। ফলে নিরপেক্ষ বিবেচনায় বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলিকে টেক্সট-বুক গণহত্যার প্রক্রিয়ায় পড়ে।

লেমকিনের মূল অভিপ্রায়

রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে ‘জেনোসাইড’ শব্দটি তৈরি করেন মূলত নাৎসি জার্মানির ইহুদিবিরোধী নিধনযজ্ঞকে চিহ্নিত করতেই। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন জেনোসাইড অন্য যে কোনো হত্যাযজ্ঞের সাথে নিজেকে পার্থক্য করে মূলত একটা জায়গায়, সেটা হচ্ছে মানুষকে নিশ্চিহ্ন করবার প্রয়াস কি একটা বিশেষ উদ্দেশে বা নিয়তে হচ্ছে কি না। ফলে এই সংজ্ঞায় জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণেও গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসকে যুক্ত করতে হবেই।

আমরা বাংলাদেশে দেখেছি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একজন পুলিশ সদস্য বলছেন, ‘একটা মারলে আরেকটা আসে এইটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা’। অর্থাৎ ইলিমিনেশন সমস্যা নয়, মেরে শেষ করে ফেলা যাচ্ছে না সেটাই সমস্যা, শেষ করে ফেলা গেলে সমস্যা হতো না। পুলিশের সেই বক্তব্যে মন্ত্রীকে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতে দেখা যায়। এখানেই নির্মূলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার প্রমাণ মেলে।

১৯৪৮ সালে তৈরি হওয়া ‘Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide’-এ রাফায়েল লেমকিনের পুরো সংজ্ঞাটা স্থান পায়নি। গণহত্যায় নির্মূল বলতে জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর নির্মূলের কথাই কেবল বলা হয়েছে। স্থান পায়নি রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র চেয়েছিল নিজেদের ভবিষ্যৎ ‘রাজনৈতিক নিপীড়ন’ আন্তর্জাতিক বিচার থেকে দূরে রাখতে। পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিরাও পরবর্তীতে পছন্দমতো রাজনৈতিক দমন চালাতে চাইছিল। লেমকিন নিজে বেশ হতাশ হন এই প্রসঙ্গে।

পরবর্তীতে রুডলেফ জোসেফ রামেল দেখিয়েছেন বিশ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রের মদদে রাষ্ট্রের হাতে সিস্টেমেটিকভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে একুশ কোটির বেশি মানুষ, কিন্তু জাতিসংঘের সংজ্ঞায় এসব গণহত্যার আওতায় পড়েনি। লেমকিনের স্ট্যাটিস্টিক্স অব ডেমসাইড গ্রন্থে তিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের ঘটনাকেও রাষ্ট্রের হাতে (পাকিস্তান) সিস্টেমেটিকভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করেছেন। আমরা জানি, জাতিসংঘ এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যাকেও পুরোপুরি জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।

জাতিসংঘের সজ্ঞায়নের কারণে অনেক ঘটনাকেই জেনোসাইড হিসেবে ঘোষণা করা যায় না—যেমন সোভিয়েত গুলাগ, চিলি পিনোশের সময়, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ণো-সুহার্তো যুগের হত্যাকাণ্ড বা কেম্বোডিয়ায় পল পটের অধীনে রাজনৈতিক নিধন, একাত্তরে বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা ইত্যাদি। কিন্তু আধুনিক গবেষকরা এগুলোকে একই ধরণের ঘটনাকে গণহত্যা বলে রায় দেন।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে তরুণ-ছাত্র সমাজ, বিরোধী মতাবলম্বী ও আন্দোলনকারীদের একটা বিশাল অংশকে নিশানা করে হত্যা করা হয়েছে, তা কেবল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়ের কারণেই ঘটেছে বলে নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান। লেমকিন ও বহু বিশ্লেষকের সংজ্ঞায় এটা স্পষ্ট, যদি গ্রুপকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের চেষ্টা চলে, তাহলেই সেটি গণহত্যামূলক অপরাধ।

জাতিসংঘের হিসেবে জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ১৪০০ মানুষকে হত্যার ঘটনা অত্যন্ত বড় পরিসরে গণহারে হত্যা।  নারী, তরুণ— সবাই ভুক্তভোগী, নিহতদেও ১৩% ছিলও শিশু যা স্পষ্টত ‘ইন্ডিক্রিমিনেট’ হামলার চিত্র তুলে ধরে। 

জাতিসংঘ দেখিয়েছে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি সবাই একযোগে নির্দিষ্ট নির্দেশ পেয়েছে মানুষ হত্যা করার, ইন্টারনেট ব্লক, গুম, মধ্যরাতে অভিযান চালানো হয়েছে—এসব নিপীড়নের সামগ্রিক কাঠামো পদ্ধতিগত। আইনি প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে বহু লোককে গ্রেপ্তার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ—এটি নিয়মতান্ত্রিক নিধনের দিকেই ইঙ্গিত করে।

জুলাইয়ে ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠী’কে নিশ্চিতভাবে নিশানা করা হয়েছে। সর্বোপরি আন্দোলনকারীদের অপরাধ একটাই— তারা কোটাবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল এবং পরে সরকার পতনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। সরকারের বক্তব্যে সব সময়ই ‘চক্রান্তকারী,’ ‘অনুপ্রবেশকারী,’ ‘দেশদ্রোহী’—এইসব উপাধি দিয়ে তাদের অমানবিকীকরণ করা হয়েছে। 

কয়েকদিনের মধ্যে কিছু ঘটনা নয়, বরং পুরো জুলাই-আগস্ট জুড়ে স্থায়ী নিপীড়ন চলেছে। গ্রেগরি স্ট্যান্টনের মডেলে (classify → exterminate → deny) আমরা একে একে সব ধাপ দেখতে পাই।

গবেষক পোর্টার, ক্যাট্‌জ, হার্ফ, শো, হোরোউইটজ—প্রত্যেকেই স্বীকার করেন যে এই ধরনের গোষ্ঠী নিধন নিঃসন্দেহে ‘গণহত্যা’ যায়।

বাংলাদেশের জুলাই–আগস্ট (২০২৪) সময়কালে সংঘটিত সহিংসতা শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন ‘সরকারি অভিযান’ ছিল না। অনেকগুলো সাক্ষ্য-প্রমাণ ও জাতিসংঘের প্রতিবেদন ইঙ্গিত দেয় এটি ছিল ‘আন্দোলনকারীদের সশরীরে ধ্বংস বা নির্মূল করার উদ্দেশ্যে’ পরিচালিত এক ভয়াবহ অভিযান। শিশুসহ শত শত মানুষ নিহত, হাজারো গ্রেপ্তার ও গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ ইত্যাদি সব মিলে এটি ‘রাষ্ট্র কর্তৃক রাজনৈতিক নিধনযজ্ঞ’—যা অধিকাংশ আধুনিক সংজ্ঞায় জেনোসাইডের সংজ্ঞামতে পড়ে। লেমকিনের মূল ধারণা বা স্ট্যান্টনের আট ধাপের আলোকে জুলাই-আগস্ট সময়কার ঘটনাকে একটা টেক্সটবুক-কেস বলা চলে। রাষ্ট্র তার আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবহার করে নিরস্ত্র নাগরিকদের সামগ্রিকভাবে দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। 

বিশ শতকের পরবর্তী সময় থেকে ‘রাজনৈতিক নিধন’ যে গণহত্যা-উপাদান বহন করে—সেটা হিটলার-স্তালিন থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার বহু রাষ্ট্রে দেখা গেছে। বাংলাদেশও শেখ হাসিনা সরকার একটি শ্রেণি, পরিচয় বা গোষ্ঠীকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করা হয়েছিল। এই নির্মমতাকে অনেকেই তখনই তুলনা করেছিলেন মধ্যযুগীয় বর্বরতার সাথে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সেই নির্মম বাস্তবতা আরও নির্ভুলভাবে উঠে এসেছে।

সুতরাং, এ কথা স্পষ্টভাবেই বলা যায় জুলাই-আগস্ট (২০২৪) সময়কালে বাংলাদেশের সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের নিপীড়ন নিঃসন্দেহে জেনোসাইডের সব চিহ্নকে ধারণ করে।

লেখাটি আরিফ রহমানের ফেসবুক থেকে নেওয়া