রাষ্ট্র, মতাদর্শ ও উৎসব
কোনো কিছুকে 'জাতীয়' করতে ক্ষমতার ‘কোমল’ বা ‘কঠোর’ এই দুই রূপের যেকোনো একটিকে ব্যবহার করা প্রয়োজন পড়ে। জাতীয় উৎসবের ধারণাকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিকতার জন্য জরুরি মনে করা হয়। একক জাতীয়তা ও সংস্কৃতি বোধের নির্মাণে জাতীয় উৎসব ভূমিকা রাখে। তাই কোনো কোনো উৎসবকে ‘রাষ্ট্র’ জন্ম দেয় বা পৃষ্ঠপোষকতা করে। অথবা, শাসকগোষ্ঠী তাদের মতাদর্শকে ছড়িয়ে দিতে, প্রশ্নহীন করতে বা সার্বজনীনতার বাতাবরণ তৈরি করতেও উৎসবের শরণ নেয়। স্মৃতিকে জীবন্ত রাখতেও উৎসব-আয়োজন ও অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। স্মৃতি চর্চারও নীতি ও রাজনীতি আছে। উৎসবের ধর্ম আছে, রাজনীতি ও অর্থনীতি আছে। তাই রাষ্ট্রীয় বা শাসকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসবে অংশগ্রহণ সর্বদা ততটা নির্দোষ ব্যাপার নয়, যেমনটা পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ হয়।
পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মানুষের হৃদয়ে যে সাড়া ও আকুতি থাকে, জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তার কতটা থাকে তা অনুসন্ধান সাপেক্ষ। ভাতা ও আদেশের বদৌলতে উৎসবের আমেজ আসে যদিও-বা, তবে তাতে থাকে তড়িঘড়ি ও নিষ্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতা, যেন শেষ হলেই বাঁচি-ভাব। উৎসব পালনের রাষ্ট্রীয় আইনি বাধ্যবাধকতা উৎসবে আনে 'ধর্মীয় গাম্ভীর্য' (সরকারি চাকুরেরা জানেন এটা)। উৎসব যেন রাষ্ট্রের ধর্মাচার। ধর্মের উৎসব আছে, দিবস আছে। রাষ্ট্রের দিবস ও আচারসমূহ তাই হয়তো ধর্ম প্রশ্নকেও সামনে আনে। উৎসব বা মিখাইল বাখতিন কথিত "কার্নিভাল"-এর ভেতর দিয়ে সামাজিক স্তরায়নজনিত অসাম্য স্থগিত হয় কিয়ৎ কালের জন্যে হলেও; তাই, রাষ্ট্র বা ক্ষমতা কাঠামো লোকেদের মধ্যে এক ধরনের সাম্যের কৃত্রিম বোধ দিতেও উৎসবকে গুরুত্ব দেয় বা উৎসব উৎপাদন বা উদযাপন করার আয়োজন করে।
মুখোমুখি পরিচয়ের সুযোগ থাকার সুবাদে এবং ক্ষমতা-সম্পর্ক কম জোড়ালো হওয়ায় পরিবার ও সমাজ নিত্য নতুন উৎসব সৃজন করতে পারে, বা বহমান কোনো প্রচলনকে নতুন চেহারায় উদযাপন করতে পারে।পরিবার ও সমাজের ছোট পরিসরে সৃষ্টিশীলতায় যতটা প্রাণ থাকে, রাষ্ট্রের বৃহৎ পরিসরে ততটা থাকে না। যোগাযোগের তীব্রতা ও তাৎক্ষণিকতায় অবশ্য রাষ্ট্র বহু দূরত্বে অবস্থানরত মানুষের মধ্যেও সমাজবোধ তৈরি করতে পারে, যেভাবে জাতীয়তাবোধ তৈরি হওয়ার কথা বেনেডিক্ট এন্ডারসন বলেছিলেন, সেভাবে। তবে ভিজ্যুয়াল ও সোশ্যাল মিডিয়া দিন দিন যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে সেক্ষেত্রে কোনো একক ধারণা, উৎসব বা মতাদর্শ সার্বজনীন কিংবা আধিপত্যশীল হওয়ার সম্ভাবনা কমবে বলে ধারণা করি।
ধর্ম, ভাষা, ভূগোল ইত্যাদি পরিচয়ভিত্তিক উৎসব সার্বজনীন হয় না। উৎসবকে সার্বজনীন হতেই হবে এমন গুয়ার্তুমি ধীরে ধীরে কমবে অবশ্য (নাকি বাড়বে!)। যখন কোনো উৎসবকে রাষ্ট্রের তরফ থেকে সার্বজনীন করার আয়োজন চলে, তখন এর ভেতরকার মতাদর্শিক উদ্দেশ্য অগোচর থাকে না।
তবে, আমার ধারণা পহেলা বৈশাখের ব্যাপ্তি আরো বাড়বে। ভবিষ্যতে আরো নানা করপোরেট হাউজ উৎসবের আমেজ তৈরি করে মুনাফা করবে ও এই উৎসবকে জনগণের বিনোদন ও বাৎসরিক অবকাশ উদযাপনের বড় ক্ষেত্রে পরিণত করবে। গান , নৃত্য, খানাপিনার আয়োজনের মধ্যদিয়ে মধ্যবিত্তের এই উদ্ভাবন ছড়িয়ে পড়বে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। পশ্চিম বাংলার মিডিয়া যদি পয়লা বৈশাখ উদযাপনে আরো বেশি অনুষ্ঠান আয়োজন করে (এ সম্ভাবনা অবশ্য কম) তবে আমাদের দেশি ও ওপার বঙ্গীয় আয়োজন মিলে বৃহৎ এক উৎসবে পরিণত হতে পারে পহেলা বৈশাখ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিমবঙ্গে পূজা-পার্বণের যে জাঁকজমক ও উৎসাহ, তা পহেলা বৈশাখের উদযাপনকে ছাড়িয়ে যায়৷ ওপার বাংলায় সংস্কৃতিই ধর্ম; ধর্ম ও সংস্কৃতির ভেদ তাদের মধ্যে নেই।
এই উৎসব ধর্মীয় আবেগকেও ছাড়িয়ে যায়। সম্ভবত এ-যুগ ভোগের যুগ হওয়ায় আনন্দ করার কোনো উপলক্ষ্যকেই মানুষ হাতছাড়া করবে না। আর বৈশাখী ভাতা প্রবর্তনের ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও আয়োজনের উদ্যম তৈরি হচ্ছে ও হবে। বেসরকারি পর্যায়েও এই ভাতা দেওয়া শুরু হবে বা হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। এই ভাতা পোশাক শ্রমিকদেরও পাওয়া উচিত, নামেমাত্র হলেও। সরকারি তাগিদ থাকলে মালিকরাও ইচ্ছুক হবে শ্রমিকদের এই ভাতা দিতে। এভাবে এই উৎসব অধিক সংখ্যক মানুষকে আনন্দ সম্মিলনীতে যুক্ত করতে পারে৷ আর, বিগত রেজিম বাঙালি সংস্কৃতির এক হিন্দুয়ানি সংজ্ঞা ও অবয়ব হাজির করেছিল এবং তারা এই আয়োজনকে এমনভাবে উদযাপন করার উদ্যোগ নিতো যেন তা কলকাতায় উদযাপিত পুজার সমতুল্য হয়ে উঠে, ফলে বাঙালি মুসলিমদের এক বিপুল অংশ বৈশাখী উদযাপন থেকে বিযুক্ত বোধ করতো।
যাহোক, সকলের ছুটির দিন হওয়াতেও পহেলা বৈশাখের সর্ববিস্তারী উৎসব হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সন্তানরা এই উৎসবের আনন্দের সাথে যুক্ত হয়ে এটিকে ছড়িয়েও দিচ্ছে। এই উৎযাপন হয়তো আরো প্রসার ও জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখ পালনও আরো বিস্তৃত হবে। ধর্মীয় প্রসঙ্গ তুলে যারা এই উৎসবের বিরোধিতা করেন, তারা খুব শিগগিরই হয়তো ফতোয়া খুঁজবেন কিভাবে ইসলামি আদব বজায় রেখেই উৎসবে সামিল হওয়া যায়।
হয়তো এভাবে বলা হবে : "পর্দার সাথে উৎসবে অংশগ্রহন করতে হবে। শালীনতার সাথে আনন্দ করলে এই উৎসবে অংশগ্রহণ নাজায়েজ কিছু নয়। এটাকে গ্রহণ করতে হবে নির্দোষ বিনোদন হিসেবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ বন্ধ করে দূরত্ব বজায় রেখে উৎসব উপভোগ করা যাবে। নামাজ-কালাম ঠিক রেখে এই উৎসবে-আয়োজনে যোগদান করা যাবে।"
জোর দিয়েই বলা যায়, পয়লা বৈশাখের সম্ভাবনা আছে সবচেয়ে বৃহৎ উৎসবে পরিণত হওয়ার, আমি আপনি চাই বা না চাই। বাঙালি মুসলমান সবচেয়ে বেশি আনন্দ করে এই বৈশাখেই। বাঙালি হিন্দুর পূজার আয়োজন বিপুল-বিশাল। তার আনন্দের জন্য ও বাঙালিয়ানা প্রদর্শনের জন্য পয়লা বৈশাখ অতো জরুরি না। বাঙালি হিন্দুমাত্রই সেক্যুলার বলে বিবেচিত, তাদের ধর্মীয় উৎসবও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাপার হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়।
"দ্য ইনভেনশান অব ট্র্যাডিশন" রচনায় ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক এরিক হবসবমের ঐতিহ্য সম্পর্কে বিশ্লেষণ সংস্কৃতি ও উৎসবের তাৎপর্য বুঝতে সহায়ক হবে। আমরা প্রায়শই যে উৎসব, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যকে প্রাচীন বলে মনে করি, তা প্রায়শই একটা উদ্ভাবিত বা ইনভেন্টেড ব্যাপার। ওই উদ্ভাবিত ঐতিহ্য সমাজে বিশেষ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন রেজিম উৎসবকে তাদের পলিটিক্যাল লেজিটিমেসিকে বা রাজনৈতিক ন্যায্যতাকে সংহত করবার জন্যে ও বিশেষ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে চাড়িয়ে দিতে ব্যবহার করে; রাষ্ট্র প্রযোজিত উৎসব, আলথুসার কথিত "ইডিওলোজিকাল স্টেইট এপারেটাস" বা মতাদর্শ বিস্তারের কোমল হাতিয়ার। বর্তমান সরকার যে উৎসবের মধ্যে "মুসলিম উপাদান" ব্যবহার করতে আগ্রহী হচ্ছে, এটা দেশের বৃহত্তর মুসলমানসমাজ, যাদেরকে সাংস্কৃতিকভাবে দীর্ঘকাল অপর করে রাখা হয়েছিল, তাদেরকে নিজত্বের অনুভূতি দেবার চেষ্টা, যা একই সাথে মতাদর্শ ও ইনসাফ। ধরা যাক ঈদের কথা। বাঙালি মুসলমানের ঈদগুলোকে নিষ্প্রাণ ও নিরানন্দ করে রাখা হয়েছে দশকের পর দশক। আমাদের সেক্যুলার ও উপনিবেশী মন এই নিষ্প্রভ ঈদের পেছনে অনেকটাই দায়ী। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সামাজিক উদ্যমের অভাবের কারণও নিহিত আছে এতে। যদিও, ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্য লক্ষণীয়, কেনা-বেচায় আগ্রহেরও খামতি নেই কোথাও। তারপরও ঈদের দিনগুলো এমন নিরস-নিষ্পৃহ কেন যায়? ঈদের দিন আসবার আগেই যেন ঈদ ফুরিয়ে যায়! বর্তমান রেজিম ঈদ উদযাপনে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়ায় অনেক শহরেই বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে ঈদ পালিত হয়েছে।
বাংলাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী এক অর্থে মাইনোরিটি, কারণ মাইনোরিটি ব্যাপারটা যতটা সংখ্যার লঘুত্ব বোঝায়, তারও চেয়ে বেশি বোঝায় ক্ষমতার সংশ্রবহীনতাকে ও ক্ষমতার বিবিধ কেন্দ্র থেকে বিযুক্ততাকে। পতিত রেজিমে এবং "ওয়ার অন টেরর" এর পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম পরিচয় যে কাউকে একজন ক্ষমতাহীন ও প্রান্তিক মানবে পরিণত করে ফেলতো। তাই, পহেলা বৈশাখ উৎযাপনে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক চেতনাকে বিশেষ সংবেদনশীলতায় দেখা একটা ইনসাফপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। তা ছাড়াও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উৎসব-আয়োজন জাতিগঠন ও জাতীয় পরিচয় নির্মাণে ও জনসংহতি তৈরিতেও ভূমিকা রাখে৷ উৎসবের কিছু স্থায়ী অনুষঙ্গ থাকে (টাইমলেস) এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন মাত্রাও উৎসবে যুক্ত হতে পারে৷ একই সাথে পরিবর্তিত ও ধারাবাহিক বা পরিবর্তনহীন উপাদান উৎসবকে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক রাখে। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, পহেলা বৈশাখ জমিদারদের খাজনা ও ব্যবসায়ীদের বকেয়া আদায়ের দিন ছিল, তাই এই দিন আনন্দের ছিল শুধু এই দুই সম্প্রদায়ের জন্যেই। কিন্তু ধীরে ধীরে জাতি গঠনের প্রয়োজনে পহেলা বৈশাখের উৎসবকে ফলিয়ে তোলা হয় এবং এটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সংস্কৃতি মাত্রই সংকর, বিশুদ্ধ সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। হোমি ভাবা কথিত "হাইব্রিডিটি"ই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতির ভেতরে লেনা-দেনা আছেই। বাঙালি সংস্কৃতি বলেও একমাত্রিক কিছু নেই। ক্ষমতা সংস্কৃতি তৈরি করে, সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে মিডিয়াও, আর এটিকে ছড়িয়ে দিতে পারে উদ্যমী মানুষের একদল। বিশেষভাবে বললে, পুঁজিবাদী সমাজের উৎসবের অবশ্যই দরকার হয় এবং তা টিকিয়ে রাখারও প্রয়োজন হয়। রাজনীতি ও অর্থনীতি ছাড়াও আছে উৎসবের মনস্তত্বও, যেটার অনুসন্ধান এ তল্লাটে হয়নি এক ফোঁটাও। তবে, এতটুকু বলে রাখি, আনন্দ ও উৎসব এমনই সংক্রামক ও বিস্তারী যে, এটির বিরোধীরাও লুকিয়ে- ছাপিয়ে হলেও এর আমেজটুকু উপভোগে বিরত থাকতে পারেন না।
জগলুল আসাদ, শিক্ষক ও লেখক। সম্পাদক, "চিন্তাযান"।