একনায়কের পতন হতে কোন শক্তি না অপশক্তির উদ্ভব হয়

একজন মানুষকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হয়। একজন রাজনীতিবিদ বা শাসককেও তাই করতে হয়। ইতিহাস পর্যালোচনায় একজন ব্যক্তির প্রাথমিক জীবন থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত বিশ্লেষণ করা হয়। দুনিয়ার তামাম শাসক ও রাজনীতিবিদরা ইতিহাসের আতশি কাচের নিচে গিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে একজন বিরল। তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার জীবনের মধ্যাংশ নিয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু শুরুর রাজনৈতিক জীবনের কথা বলা হয় না। শেষ জীবনের বিষয়াবলিও উল্লেখ করা হয় না।

শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধা। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ তাকে সামনে রেখে হয়েছে। আবার তিনি স্বাধীনতার পরপরই একদলীয় ফ্যাসিবাদ কায়েমেরও স্থপতি। বাকশাল কায়েম করেছেন, রক্ষী বাহিনী দিয়ে নির্বিচারে সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছেন। শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করেছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি চাইলে রাজা, বাদশাহদের মত ফরমান বা ডিক্রি জারি করে নিজেই আইন ঘোষণা করতে পারতেন। সংসদ বাতিল করতে পারতেন। তিনি অনেকটা রাশিয়ার জার ও ইরানের শাহ এর ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। বা রাজ, বাদশাহদের মত। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হন।

১৯৭১ এর ১৫ জানুয়ারির সংবিধান সংশোধনী অনুসারে আইনগত বা বৈধভাবে তাকে প্রতিস্থাপনের কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি কার্যত আজীবনের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ কথা কোথাও আইনগতভাবে লেখা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা তাই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি ছিল কেবল।

তাকে হত্যা করা হয়েছে ৭১ পরবর্তী একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের জন্য। ১৯৭১ সালে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আটক হয়ে পাকিস্তানের জেলে চলে যান। ফলে তিনি যুদ্ধের ময়দানের নেতৃত্ব দিয়ে অন্য অনেক রাজনীতিবিদের মত দেশ স্বাধীন করেননি। দেশের সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে তাকে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত করেছে। আর সেই মুক্ত স্বাধীন দেশে তিনি দ্রুতই ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন।

তিনি নিজ দেশের মানুষদের হত্যা শুরু করেন। যা পরবর্তীদের তার কন্যা শেখ হাসিনাও অনুসরণ করেছেন দ্বিতীয় বাকশালের আমলে। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পরপরই জনসাধারণকে দেশের প্রতিপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করেছে। আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করি। শুধু স্বাধীনতার যুদ্ধ দিয়ে না।

আওয়ামী লীগের লোকজন একটা কথা বলে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করবে তারা। কিন্তু ৭৫ এর আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিব মজলুম ছিলেন না। মজলুমের শোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আর তিনি ছিলেন একনায়কতান্ত্রিক শাসক। একনায়কের পতন হয়। এই পতন থেকে কোনো শক্তির উদ্ভব হয় না। যা দেখা যায় তা হচ্ছে অপশক্তি। ফলে ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ অপশক্তি হিসাবে ফিরে এসেছে। যে কারণে ২৪ এর ৫ আগস্ট তাদের পালাতে হয়েছে।

১৫ আগস্ট আসলে যারা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করেন, তারা খণ্ডিত ইতিহাসের শিক্ষার্থী। তারা এক চোখে ইতিহাসকে দেখেন। তারা বাকশাল, রক্ষী বাহিনীকে আড়াল করতে চান বা বাকশালকে এখনো ধারণ করেন। ব্যক্তিপূজার জায়গা থেকে তারা শেখ মুজিবকে বিবেচনা করেন। ইতিহাসের নির্মোহ শিক্ষার্থী তারা নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের উপর এক ধরনের দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে।

নির্মম মনে হলেও সত্য যে ১৫ আগস্টের পরিণতি শেখ মুজিব নিজেই তৈরি করেছিলেন। তাকে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা থেকে সরানোর কোনো গণতান্ত্রিক পন্থা তিনি রাখেননি। যে কারণে তাকে সপরিবারে হত্যার পর সারা দেশে কোনো প্রতিক্রিয়া বা গণবিক্ষোভ দেখা যায়নি। ২৪ এর মতই আওয়ামী লীগ পালিয়ে গিয়েছিল।