মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় বিএনপি

গত বছর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের ছবি। ফাইল ফটো

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ৪ মাস চলে গেলেও বড় কোনো কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামেনি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। নির্বাচনের পর প্রথম তিন মাস থিতু থাকার পর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আবারও উষ্ণ হতে শুরু করেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে ভেতরে আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে তারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভোটের এতদিন পরও গুছিয়ে উঠতে পারেনি সরকার। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ব্যাপক মাত্রায় বর্জন করেছিল সাধারণ মানুষ। তিনমাস পর উপজেলা নির্বাচনেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা সরকারর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। উপজেলার মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রমুখি হননি, এটাকে খুব ভাল সংকেত বলে মনে করছেন না অনেকেই।

অন্যদিকে নানা চেষ্টা সত্ত্বেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদে কোনো কার্যকর বিরোধী দলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি। একদলীয় সংসদে সরকার পক্ষীয় সদস্যদের উপস্থিতি নাগরিকদের আশাহত করে চলেছে।

এর সঙ্গে নানা বিতর্কিত বিষয় সরকারকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের দুর্নীতির নানা খবর, এমনকি নিজ দলের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডও সরকারের বিপক্ষে তীব্র জনমত তৈরি করেছে। ছোট-বড় আরো নানা দুর্নীতির খবর সামনে আসতে শুরু করেছে। সরকারও কিছু ব্যবস্থা নিয়ে নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চাইছে। কিন্তু এ নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

নির্বাচনের আগে মূল্যস্ফীতি কারণে অস্থিতিশীল হওয়া বাজারে নির্বাচনের পর নতুন করে কোনো সুখবর আসেনি। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। রিজার্ভ সংকট, রপ্তানি আয় হ্রাস, রেমিট্যান্সে মন্দা, শ্রম বাজারে অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদরা বড়সড় সংকটের পূর্বাভাস দিয়ে চলেছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের সরবরাহও কমে আসতে পারে।

সামনের বাজেটের অর্থসংস্থান করাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।  

এই সংকটের মধ্যে মাঠে মার্কিনিদের আগমন সরকারের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। সরকার ধারণা করছিল, ভারতের দূতিয়ালিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের নীতিতে আগাবে। কিন্তু, ডোনাল্ড লুর সফরের পর সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা সরকারকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আজিজ আহমেদের ওপর ব্যবস্থাগ্রহণের পাশপাশি বর্তমান ব্যবস্থাটিকে কিল্পটোক্রেসি বা চোরতন্ত্র আখ্যা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ধারণা করা হচ্ছে, সরকারের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ৫ বিলিয়ন ডলার চীনা ঋণ, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন ও ভারতের টানাহেঁচড়া, মিয়ানমারের যুদ্ধে বিদ্রোহীদের বিজয় সামনে দিনে সরকারকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই-আগস্টে সরকারকে কঠিন সময় পার হতে হবে। ৭ জানুয়ারির ‘ডামি নির্বাচনে’র পর আন্দোলন গোছাতে বিরোধীরা যথেষ্ট সময় নিয়েছে। এবার তাদের মাঠে নামতে হবে।

বিরোধীরাও ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত। মে মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক ভার্চুয়াল সভায় নতুন করে আন্দোলন সংগ্রামে নামার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা। বৈঠকে নির্বাচনের আগের আন্দোলন-সংগ্রাম পর্যালোচনা ও নতুন আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

দলগুলোর শীর্ষ নেতারা জনিয়েছেন, নতুন করে আন্দোলন সংগ্রামে নামতে সময় লাগবে আরও মাস খানেক। তারা এ বিষেয়ে একমত যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা মনে করছেন এখনই সময় রাজপথে নামার।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আগামী দিনে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করার জন্য আমরা কাজ করছি। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে আলোচনা করেছি আমরা। তবে কি ধরনের কর্মসূচি দিয়ে শুরু করবো কিংবা কবে থেকে শুরু করবো তা নিয়ে চূড়ান্ত কিছু হয়নি। সব কিছু গুছিয়ে রাজপথে নামতে কিছুটা সময় লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলেন। তবে আমরা কারো ভরসা কিংবা আশ্বাসে বিগত দিনে আন্দোলন সংগ্রাম করিনি। আগামীদিনেও কারো দিকে তাকিয়ে নেই। কেউ আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে তেমন ভাবনা আমাদের নেই। জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা নিয়ে নিজেদের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম সফল করবো।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমরা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই রয়েছি। সামনে নতুন কর্মসূচি আসবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি চূড়ান্ত হবে।’
রাজপথের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি গত ১২ মে থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে।

আগামীর আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সাবেক সেনা প্রধান আজিজ ও সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার অন্যতম হাতিয়ার ছিল। এই দুইজন এখন ধরাশয়ী। পাশাপাশি অর্থনীতির বেহাল দশা। বিদেশি সংস্থাগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হবে এবং বকেয়া বিল পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে বেকায়দায় আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় বিএনপিসহ আমরা সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে বৈঠক করছি। আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘ধারাবাহিক কর্মসূচি আসবে। সভা-সমাবেশ-মিছিলের মতোন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামবো আমরা। নানা অপকর্মের কারণে সরকার বেকায়দায় রয়েছে। এর বাইরে দেশের অর্থনৈতিক সংকট চলমান রয়েছে। সেটি সামনে আরও বাড়বো। সব মিলিয়ে একটা মোক্ষম সময়ে সবাই মিলে রাজপথ নামবো আমরা।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ‘গত ১৫/১৬ বছর ধরে আমরা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই আছি। জালিম, জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘সরকার এখন নানামুখী চাপে রয়েছে। এখনই আন্দোলনের উপযুক্ত সময়। তাই যতদ্রুত সম্ভব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে রাজপথে নামা উচিত। কারণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা জনগণের প্রতি ভোট বর্জনের আহবান জানিয়েছিলাম। জনগণ তাতে সাড়া দিয়ে ভোট বর্জন করেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব জনগণকে তাদের ভোটাধিকার, মানবাধিকারসহ সব ধরনের হারিয়ে যাওয়া অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। এটি করতে না পারলে জনগণ আমাদের ওপর আস্থা হারাবে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর আন্দোলন-সংগ্রামে সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতা ছিল। যার কারণে আমরা ফসল ঘরে তুলতে পারিনি। আগামীদিনে যাতে সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতা না থাকে সে জন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে যারা অভিজ্ঞ তাদেরকে নিয়ে কমিটি করতে হবে। আগামীতে যে আন্দোলন হবে তাতে ব্যর্থ হওয়া যাবে না।’

শরিক দলগুলোর নেতারা বলছেন আগামীদিনে সভা, সমাবেশ, মিছিলের মতোন কর্মসূচি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে মাঠে নামার চিন্তাভাবনা রয়েছে। এসব আন্দোলনের কর্মসূচি আগস্ট থেকে শুরু হতে পারে। ধাপে ধাপে আন্দোলনকে চূড়ান্তরূপ দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে।

সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞায় খুশী হওয়ার কিছু নেই। আমার নিজের ঘর যদি নিজে সামলাতে না পারি, অন্য কেউ ঘর সামলে দেবে না। সেজন্য বলছি, নিজেদের পায়ে নিজেদের দাঁড়াতে হবে, নিজেদের শক্তি নিয়ে দাড়াতে হবে এবং নিজের শক্তি নিয়েই এদেরকে পরাজিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় ভুল ব্যাখ্যা করা হয় যে, আমরা নাকি উৎখাত করতে চাই। আমরা উৎখাতের কথা বলিনি, উৎখাত করতে যাবো  কেন? আমরা ভোটের অধিকার চাই, সেই ভোটের মধ্যদিয়ে আমরা তোমাদেরকে পরাজিত করবো। সেই ভোটের অধিকার অর্জন করার জন্য আমাদের সবাইকে আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’