বিএনপির সঙ্গে নয়, পৃথকভাবে আন্দোলনে থাকবে জামায়াত
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। ইতিমধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা বৈঠক করেছেন। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক করেনি লিয়াজোঁ কমিটি।
ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে রাজপথে যুগপৎভাবে আন্দোলন করেছে আগামী দিনের আন্দোলনও সেভাবেই চলবে।
গত মে মাসে গঠিত বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে আগামীদিনের করণীয় সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি বিগত আন্দোলনের ব্যর্থতা নিয়েও আলোকপাত করা হয়। এসব বৈঠকে কিছু দল আন্দোলনে জামায়াতকে সরাসরি সম্পৃক্ত না করাকে আন্দোলনে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ বলে মত দেন। এসব বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের বাইরের অন্য শরিকরা আগামী আন্দোলনে জামায়াতকে সরাসরি পাশে রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। গণতন্ত্র মঞ্চ আগে জামায়াত ইস্যুতে সরাসরি বিরোধিতা করলেও এবারের বৈঠকে নিরব ছিল। বিশেষ করে সমমনা ১২ দলীয় জোট, এলডিপিসহ বেশ কয়েকটি দলের বক্তব্য হলো- অতীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করেছে। তাহলে জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আন্দোলন করলে দোষ কোথায়? তাই আন্দোলনের নতুন কর্মপরিকল্পনায় জামায়াতকে রাখতে আগ্রহী তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আগামীর আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী থাকবে কি না সে বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যুগপৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতের বিষয়ে আমাদের আপত্তি ছিল। বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখার পর মঞ্চের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর যারা শীর্ষ নেতা রয়েছেন তাদের সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এ বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো।’
গণতন্ত্র মঞ্চের বাইরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা বলেন, ‘গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপি মহাসমাবেশ করেছে। একই সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পৃথক পৃথক স্থানে সমাবেশ করেছে। সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। সেদিন রাজপথে লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক ছিল। পুলিশ বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা করে তা পণ্ড করে দেয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ ছিলো শান্তিপূর্ণ। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। ঐদিন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারতো। ভারত ক্ষুব্ধ হতে পারে এমন আশঙ্কায় বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নেয়নি। অথচ প্রতিবেশী ভারত বিএনপির পাশে না দাঁড়িয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ নেয়। তাই ভারত অখুশী হবে সে আশঙ্কায় না থেকে সরকারবিরোধী সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামীর আন্দোলন করতে হবে। শুধু ভারত নয়, কেউ আমাদের সহযোগিতা করবে না যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে পারি।’
বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, ‘আগামীদিনে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। এর অংশ হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি। তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করিনি। বৈঠক করার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে আমরা পাইনি।’
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ‘রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগামীর আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে। অতীতের মতো তারা এবারও আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। তবে আমরা বসে নেই। বিগত দিনে আমরা জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকারসহ সংবিধান স্বীকৃত আধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছি। জনগণের দাবি আদায়ে আমাদের আন্দোলন চলমান রয়েছে। আগামীদিনেও আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
উল্লেখ্য ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সেই নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল জামায়াত। এরপর থেকে দল দুইটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। তবে সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে আন্দোলন করেছিল জামায়াত তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছিল। এরপর ১৯৯৯ সালের শুরুতে এসে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক জোটে রূপ নেয়। তখন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। এই জোটই ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় জায়গা পান জামায়াতের দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ। তারা দুজনই পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটও পরে বিশ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। ২০১৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করলে জামায়াতও সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব বিএনপিসহ কয়েকটি দল যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করেছিল সেখানে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন জামায়াত দলীয় প্রার্থীরা। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির পর প্রায় এক দশক ঢাকায় কোনো সমাবেশের অনুমতি পায়নি জামায়াত। মূলত ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে জামায়াত ইসলামী রাজনৈতিকভাবে কার্যত কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে যায়। দীর্ঘ এ বিরতির পর গত বছরের ১০ জুন ঢাকায় দলটি ডিএমপির অনুমোদন নিয়ে সমাবেশের আয়োজন করে আলোচনায় আসে।