আওয়ামী লীগকে ঐতিহাসিক কারণে সমর্থন করছে ভারত

আওয়ামী লীগ অর্থনৈতিক কারণে চীনমুখী হলেও ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিটি নির্বাচনে দলটিকে সমর্থন করে আসছে ভারত, যার ফলে একদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ঢাকায়, এমনটাই পর্যবেক্ষণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও কূটনৈতিকদের।

২০১৪ সালে ভারতের বিদেশ সচিব সুজতা সিং নির্বাচনের আগে ঢাকা এসে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে দাঁড় করিয়ে গণতন্ত্রের যে বাধা তৈরি করেছেন, সেটা মানতে নারাজ ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত। তার মতে বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচন এলে ভারত প্রসঙ্গ আসে, এটা অনেকটা অমূলক। দিল্লির সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কটা ঐতিহাসিক, তবে ঢাকায় যেই ক্ষমতায় থাকুক, ভারত তার সাথেই কাজ করবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের গণতন্ত্রের যে পুনঃ জীবন ফিরে এসেছে, সেখান থেকে প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। তাদের মত হলো বাংলাদেশে কয়েকটি বিতর্কিত নির্বাচন হলেও আগামী দিনে জনগণের রায়েই গণতন্ত্র ফিরবে ঢাকায়।

অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, ইন্ডিয়াতে আমাদের এক্কটা ভিন্নতা হলো ইন্সটিটিউশনালক্যাপাসিটি। এখানে পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে এক্সিকিউটিভ, নির্বাচন কমিশন সবগুলো আলাদা কাজ করে। নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ইন্ডিয়ার প্র্যাকটিসগুলো বাংলাদেশ অনুসরণ করে অথবা ইনেস্টিটিউশনাল এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ডেমোক্রেসিকে রিস্টোর (গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার) করতে পারে।

বাংলাদেশের একদলীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে শ্রীরাধা বলেন, আমরা দেখেছি ৭ জানুয়ারি ইলেকশনে কীভাবে মেজর অপজিশন বিএনপিকে একপাশে করে রাখা হয়েছে। অপজিশনের উচিত জনগণের কাছে মেসেজটা সঠিকভাবে পৌঁছানো। এবার তো সরকার গঠন হয়ে গেছে। আগামীতে যাতে জনগণের কাছে সঠিকভাবে মেসেজটা পৌঁছানো যায়। সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেইজিংমুখী অবস্থানে পাওয়া গেলেও এই বিশ্লেষকের ধারণা ভিন্ন।

সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শ্রীরাধা বলেন, তিস্তা ইস্যুতে যতই আলোচনা থাকুক, ভারতের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি করতেই হবে। চীন নিয়ে যে আলোচনা সেটা হয়তো অবকাঠামো নির্মানের। তিস্তার পানিপ্রবাহ, আমাদের নর্থ ইস্ট থেকে সিকিম হয়ে। বাংলাদেশ যে কারো সাথে চুক্তি করতে পারে তার অবস্থান অনুযায়ী, এটাতে কোন বাধা নেই। সেহেতু তিস্তা ইস্যুতে মেজর স্টেক ভারত ও বাংলাদেশ।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের জন্য বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে শ্রীরাধা বলেন, মংলা পোর্ট নিয়ে আলোচনা অনেক দিনের। সেটা ২০১৫ সালে শুরু হয়, এখন একটা জায়গায় পৌঁছেছে। ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে। এটা হলে আমাদের নর্থইস্টের অর্থনীতি বিকাশ পাবে। আমার মনে হয় এটা হলে ভালোই হবে।

শ্রী রাধা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো আওয়ামী লীগ নিজের স্বার্থেই বিলুপ্ত করেছে, ২০১৯ এর নির্বাচনে মানুষ ভোট দেয়ার আগেই ভোট হয়ে গেছে, এখানে ভারতের কি করার ছিল। বিএনপি বলেছিল যোগ দিবে। তারা সেভাবে সামনে আসেনি।

তিনি বলেন, সুজতা সিং যখন ঢাকা সফর করল, জাতীয় পার্টিকে বলল অপজিশন হিসেবে দেখাতে। আপনি বলুন, জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা কী! বিএনপি নিজেও, অপজিশন হিসেবে আসেনি। প্রত্যেকবার ভারতকে টানা হয়। এবারেও। এটা পুরোটাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা।

শ্রীরাধা বলেন, ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, তাই বলে কী আমরা আওয়ামী লীগ ছাড়া কাউকে চিনতে পারব না, এটা আমি বিশ্বাস করি না।

আঞ্চলিক রাজনীতির এই বিশ্লেষক বলেন, বিএনপির অনেক লিডার ভারতে এসেছে, তারা কী আমাদের কাছে কিছু বলেছে? আমি বিশ্বাস করি, মির্জা ফখরুল ইসলামের মত্ স্ট্রং লিডার আছে, তাদের সামনে আসা উচিত। আমাদের দেশে রাহুল গান্ধী পপ আপ করেছে।

শ্রী রাধা উল্লেখ করেন, ভারতের ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা পূরণ হবার নয়। তার পর খালেদা জিয়া একবার ভারতে এসেছে। কেউ তো আমাদের বলেনি সম্পর্ক পুনঃ নির্মানের বিষয়ে। বিএনপিতে আমার অনেক বন্ধু আছে। আমরা চাই তারা ক্ষমতায় আসুক। যে সরকার ঢাকায় থাকবে, তার সাথে ভারতের কাজ করতে হবে।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে দিল্লির সাথে সম্পর্কের অনিশ্চয়তা নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল, বিজেপির নরেন্দ্র মোদির জোট সরকারের পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় অনেকটাই স্বস্তিতে আছে ঢাকা, এমনটাই ধারণা কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।

ঢাকা ও দিল্লিতে কাজ করা আমলা, সাবেক রাষ্ট্রদূতদের ও গবেষকদের ধারণা, এবারের লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের রায়ের প্রতিফলন হয়েছে, যার বিপরীতে নিকট প্রতিবেশী দেশের গণতন্ত্রের অবক্ষয়ে তেমন কোন উদ্বেগ নেই দিল্লির।

নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় মেয়াদে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠনে ঢাকা দিল্লি সম্পর্কে ‘তেমন কোন পরিবর্তন আসছে না বলে ধারণা বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের।

দ্য মিরর এশিয়াকে এই সাবেক কূটনৈতিক বলেন, লোকসভা নির্বাচনে ভারতে আংশিক পরিবর্তন হয়েছে। সেটা হলো প্রধান বিরোধী দলের (কংগ্রেস) লোকসভায় ফিরে আসা।

তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতে নতুন সরকার, কিন্তু নেতৃত্ব পুরাতন, তৃতীয় টার্মে। ভারতে যে সরকারই থাকুক, বাংলাদেশের উপর একটা ‘আধিপত্য’ ধরে রাখতে চায় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে। এবারেও তেমনটি থাকবে। মেজর কোন ডিফারেন্স আমার চোখে ধরা পড়ছে না।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে দিল্লির আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের নীতি বিশ্লেষক ও কংগ্রেস সরকারের সাবেক সচিব জহর সরকার।

দ্য মিরর এশিয়াকে জহর সরকার বলেন,ভারত সবসময়ই অন্ধকার সময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে তার আন্তরিকতা বোঝাতে আরো ‘অনেক দূর’ যেতে হবে।

প্রসার ভারতীর সাবেক নির্বাহী প্রধান মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে অর্থনৈতিক কাজকর্মের পরিধি বাড়ানো। আমাদের অবশ্যই দুই বাংলাকে উৎসাহিত করতে হবে। অভিন্ন বন্ধন বা ভাষা, সংস্কৃতি ও অনুভূতিকে আরও দৃঢ় করতে হবে বলে পরামর্শ জহর সরকারের।

বাংলাদেশে একদলীয় সরকার ব্যবস্থায় মোদির ভূমিকা প্রসঙ্গে সম্প্রতি ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিল, সেই সময়ে ভারত শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।

অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠাকে দিল্লি অবশ্যই ইতিবাচক বলে মনে করে না। তার মতে, বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র যখন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের ওপরে চাপ দিচ্ছিল, ভারতের বিশ্লেষক এবং নীতি নির্ধারকরা এই যুক্তি হাজির করেছিলেন যে, এই ধরনের চাপের মুখে শেখ হাসিনা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যে এটাই ছিল প্রধান অস্ত্র।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘২০১৪ সালেও নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনকেও বিতর্কিত করার এবং সে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্থাপন করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। এবারও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানটা কী ছিল বা কী আছে, তা আপনারাই জানেন।