ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে চীন নির্ভর আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতা নিজের কব্জায় রাখতে বেশ খানিকটা বেইজিংমুখী হয়েছে আওয়ামী লীগ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে বাঁচাতে চীনের ঋণের দিকে ঝুঁকছে ঢাকা। একের পর এক ‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট’ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুবিধা পাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কূটনৈতিকদের ধারণা শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফরে তিস্তা প্রকল্পে চীনা ঋণ ও আওয়ামী লীগের বেইজিংমুখী রাজনীতির বিষয়ে ভারতকে বোঝানো একটা ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ হবে।

বহুল আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায়, ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের মাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট শি চিং পিং। রাজনীতিহীন বেইজিংয়ের পথ ধরেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় অনেকটা এগিয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা সংকটের শুরু চীনের হাত ধরেই। বার্মার পরিস্থিতি অনেকটাই চীনের নিয়ন্ত্রণে। এমন সময়ে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে বাংলাদেশের সীমান্তে চীনের ইশারায় বার্মার উপস্থিতি জোরদার হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

চীন ও বার্মার যৌথ চাপের মধ্যে হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে তিস্তার পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা ও সামরিক সহায়তাসহ ভবিষ্যৎ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও আলোচনা হবে বলে প্রত্যাশা। তবে ভারত থেকে এ মুহূর্তে নতুন করে বড় কোনো ঋণের প্রত্যাশা করছেন না বিশ্লেষকরা।

ভারত থেকে দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী ৯-১২ জুলাই এ সফর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। চীন বাংলাদেশের অন্যতম ঋণদাতা এবং বাংলাদেশ এখন ক্রমশ চীনের ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ইআরডির তথ্যমতে, ২০০৫-২৩ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে দেশে ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি বিনিয়োগ করেছে চীন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, যার পরিমাণ ৩২৭ কোটি ডলার।

নির্মাণ সংশ্লিষ্ট খাতে ২১৩ কোটি ডলার, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১১০ কোটি ডলার, আর্থিক খাতে ১৬ কোটি ও অন্যান্য খাতে ৪১ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরও চীনের প্রভাব বাড়ছে। যদিও বর্তমান সরকার এখন চীনের কাছ থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণ এবং চীনা প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।

বাংলাদেশে চীনা আধিপত্যের কারণ হিসেবে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে দায়ী করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেন। তিনি দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য দিল্লি ও বেইজিং, দুই পক্ষকেই দরকার। আমাদের অর্থনীতির যে ভঙ্গুর অবস্থা, এ ক্ষেত্রে চীনের সাথে অংশীদারত্বের বিকল্প নেই। কারণ ভারত এতো পরিমাণ অর্থ জোগান দিতে পারবে না।

তৌহিদ হোসেনের ধারনা, ঢাকায় চীনের ফুটপ্রিন্ট বেড়ে যাচ্ছে, এমন আশংকায় দিল্লিকে পরিস্থিতি বোঝানোই বড় চ্যালেঞ্জ হবে শেখ হাসিনার জন্য।

তার মতে, তিস্তা ইস্যুটা অনেকদিন ধরে আলোচনায়, কিন্ত আমরা চীনের অর্থায়নের সাথে সাথে ভারতের প্রতিক্রিয়া দেখলাম। তিনি বলেন, জিনিসটায় জটিলতা আছে। কতোটুকু, বেইজিংয়ের বিষয়ে দিল্লিকে কতটুকু নমনীয় করা যাবে এটাই দেখার বিষয়।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরকে কেন্দ্র করে চীনের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। মাত্র ১ শতাংশ সুদে সহজ শর্তে এ ঋণ মিলবে বলে আলোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশটির সঙ্গে তিস্তা প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নিয়েও আলোচনার কথা রয়েছে।

এর আগে ডলার–সংকটে থাকা বাংলাদেশকে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। বেইজিংয়ের এ আগ্রহ প্রকাশের পর চীনকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে আলোচনা শুরু হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের বিল ইউয়ানে নেওয়া ঋণ দিয়ে পরিশোধ করতে আগ্রহী। চীনের সঙ্গে আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রমে এখন মার্কিন মুদ্রা ডলার ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস এখন চীন।

বাংলাদেশের চীনমুখী রাজনীতি প্রসঙ্গে, ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশে যে কারো সাথে চুক্তি করতে পারে। তবে তিস্তায় প্রকল্পে চীনের ঋণ নেয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র অবকাঠামোগত।

তিনি তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগে ‘কৌশলগত কোন বিষয়’ বিষয় দেখছেন না বলে জানান। শ্রীরাধা বলেন, তিস্তার উৎপত্তি ও প্রবাহ ভারতের উত্তর-পূর্ব হয়ে বাংলাদেশে। এখানে স্টেকহোল্ডার শুধু দিল্লি ও ঢাকা।

ডলার–সংকট মোকাবিলা এবং ক্ষয়িষ্ণু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠেকাতে ইউয়ানে দেওয়া চীনের ঋণ বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন। চীন চাইছে ইউয়ানে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ট্রেড ফ্যাসিলিটি ঋণ হিসেবে দিতে। চীনা মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ হাজার ৬০০ কোটি ইউয়ানের বেশি।