আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রায়রিটাইজেশন রিলেশনশিপ’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে বাধ্য করবে বলে যখন মনে হচ্ছিল, তখনই অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে যায় বিশ্ব পরাশক্তির দেশটি। গত এক-এগারো পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ওপরে ওপরে বৈরি মনে হলেও, ভেতরে এক ধরনের সখ্য রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আছে ভারত। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছে এখনো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি না পেলেও নিকট প্রতিবেশীর হাত ধরে বৈতারণী পার হয়েছে আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরের পর আরো যেন নির্ভার দলটি। তার সফরের পরপরই সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে নিষেধাজ্ঞা দিলেও, সেটাকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান মনে করার কারণ দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক মূলত ‘প্রায়রিটাইজেশন রিলেশনশিপ’।
ডোনাল্ড লু গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন। এ সফরে তিনি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্য প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টাসহ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দু’দেশের সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে লু বলেন, ‘আমরা পেছনে নয়, সামনের দিকে তাকাতে চাই’।
আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ঢাকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পদত্যাগ করেন বলে খবর প্রকাশ করে ‘দ্য মিরর এশিয়া’। এর ফলে নতুন অলোচনা শুরু হয় কূটনৈতিক মহলে। পাশাপাশি ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরের সময় মিডিয়া কোয়ালিশন ভেঙে দেওয়া হয় বলেও ‘দ্য মিরর এশিয়া’ জানতে চায়। এমন প্রশ্নের জবাবে বিষয়টিকে ‘গুজব’ উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম স্বাধীনতা নিশ্চিতে’ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৫ দেশের কোয়ালিশন এখনও সক্রিয় আছে।
বোয়িং কূটনীতি
যুক্তরাষ্ট্র আর আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ‘বোয়িং’ কেনার ওপর নির্ভর করছে বলে ভাবছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের কাছে বোয়িং বিমান বিক্রির জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে কিছুটা নমনীয় মনোভাব বজায় রাখছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে সম্প্রতি বিমান মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনা ১০টা এয়ারবাস কেনার’।
বোয়িং কূটনীতির অংশ হিসেবে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) অ্যাটাচে ড্যানিয়েল জ্যাকব ৯-১২ জুন ঢাকা সফরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তপক্ষের চেয়ারম্যান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মার্কিন দূতাবাস জানায়, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি ফ্লাইটের লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা নিয়ে কথা হয়েছে বৈঠকে। অবশ্য নিউ ইয়র্কের ফ্লাইটের বিষয়টি ‘প্রেস রিলিজে’ বলা হলেও আলোচনা গড়িয়েছে বোয়িং বিমান পর্যন্ত। উল্লেখ্য, মার্কিন কর্তৃপক্ষের তালিকায় অবনমনের ফলে সে দেশে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ হারায় বিমান। ক্যাটাগরি-১ এর মর্যাদা পুনরুদ্ধারে বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চলছে।ঢাকা-নিউ ইয়র্ক সরাসরি ফ্লাইট আলোচনার মধ্যেই বোয়িং কেনার ইস্যু সামনে নিয়ে আসে ওয়াশিংটন।
ঘাঁটি ইস্যু
গত ২৩ মে একটি সভায় যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি যদি একটি নির্দিষ্ট দেশকে বাংলাদেশে একটি বিমান ঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দিতাম, তাহলে আমার কোনো সমস্যা হতো না’। আবার সেইন্ট মার্টিনে বিমান ঘাঁটি এবং বাংলাদেশ ও বার্মার মাঝে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ‘সাদা মানুষদের’ কাছ থেকে চাপ আসছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। যদিও তার উত্তর এসেছে ডনাল্ড লু’র কাছ থেকে। জার্মানভিত্তিক ডয়েচে ভেলেকে লু বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। নির্বাচনের সময় আমাদের অগ্রাধিকার ছিল শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশের সাথে কাজ করা’। এর আগে সেইন্ট মার্টিনে ঘাঁটি করার অভিযোগও উড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ‘বিমান ঘাঁটি ও খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ ইস্যুতে আলোচনা চলছে বলে যে খবর বেরিয়েছে তা নিয়ে সরাসারি কোনো মন্তব্য করতে নারাজ সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। ‘দ্য মিরর এশিয়া’কে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়ে কথা বললে তা আরো বেশি ডেটা ভিত্তিক হওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘প্রায়রিটাইজেশন রিলেশনশিপ’ (অগ্রাধিকামূলক সম্পর্ক) হিসেবে উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির বলেন, গত চার বছর ধরে আমরা দেখে আসছি, বিশেষ করে ২০২১ থেকে ওয়াশিংটন ঢাকার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্মানে আগ্রহী। নির্বাচনের আগে, ২০২৩ এ এসে তারা ‘ইনক্লুসিভ ইলেকশন’ ইস্যুতে কথা বলা শুরু করল।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের মতে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ‘বোয়িং’ থেকে অনেক গভীর। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে সুনীল অর্থনীতিথেকে শুরু করে, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের অবদান রয়েছে। জ্বালানি খাতে শেভরনের ভূমিকা আমরা জানি। তো একটা ব্রড রিলেশনশিপকে ছোটো-খাটো ইস্যু দিয়ে বিবেচনা না করাই ভালো।
নিষেধাজ্ঞা
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সবচেয়ে বড় আঘাত আসে অবশ্য যুক্তরাষে্ট্রর তরফেই। ২০২১ সালে মার্কিন অর্থ দপ্তর বাংলাদেশের এলিট বাহিনী র্যাবসহ এর ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ারর আহ্বান জানানো হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বিষয়টি নাকচ করে দেয়। এর বাইরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ নীতির আওতায় যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় -তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে।
যদিও এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হেতে দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগকেও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা হারানোর ভয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। বরং ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনে তারাই আবার ক্ষমতায় এসেছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের আচরণ গণতান্ত্রিক দেশের জন্য অমর্যাদার। এর বাইরে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেওয়া, শ্রম অধিকার কার্যকর করাসহ বিভিন্ন চাপে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। যা থেকে নিস্তার পাওয়ার সুযোগ আপাতত নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ যুক্তরাস্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ে ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ‘দ্য মিরর এশিয়া’কে বলেন, তারা (ওয়াশিংটন) নিজস্ব সুবিধামতো পলিসি বানাবে। বাংলাদেশে তারা অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। এখন যে আলোচনা (সেইন্ট মার্টিন) নিয়ে, সেটা অনেকটা পলিটিক্যাল। এটা আমাদের দেশেও (ভারত) হয়, জনগণকে কিছু বোঝানোর জন্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর ধারণা ঢাকাকে নিয়ে একটা ‘স্লো গেইম’ খেলছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের এ শিক্ষক ‘দ্য মিরর এশিয়া’কে বলেন, খেয়াল করে দেখেন, ৭ জানুয়ারি ইলেকশন হলো, ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র একটা ছোট স্টেটমেন্ট দিয়ে বলল ‘এই নির্বাচনটি ফ্রি ফেয়ার হয়নি’। তারা ফ্লাগ আউট করে রাখল বিষয়টা। তারা বলতে শুরু করল, আমরা সম্পর্ক পুনঃনির্ণয় করতে চাই। তার মানে এই নয় যে নির্বাচনের স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছে। তারা যে লাল কার্ড দেখিয়ে রেখেছে, সেটা তারা বাদ দিচ্ছে না।