আওয়ামী লীগে নির্জীব চার নেতার পরিবার
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা চার নেতার পরিবারের সদস্যরা এখন আর দলটিতে প্রভাবশালী নন। এ চার নেতাকে ‘জাতীয় চার নেতা’ হিসাবে অভিহিত করেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রী, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম। তিনি ২০২০ সালে মারা যান। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর আওয়ামী লীগে জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যদের কেউ এখন আর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিগত কাউন্সিলে তাজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে সোহেল তাজ গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেলেও বাস্তবে তা হয়নি।
চার নেতার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং মুহাম্মদ মনসুর আলীর সন্তানদের আওয়ামী লীগে প্রভাব নেই। যদিও তাদের কেউ জাতীয় রাজনীতিতে, কেউ আবার স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। দেশ ও দলের প্রয়োজনে তারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন বলে মন্তব্য রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, মোহাম্মদ নাসিম ছাড়া জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যরা সেভাবে রাজনীতিতে দ্যূতি ছড়াতে পারেননি। যার কারণে বর্তমান সময়ে আলোচনায় নেই তারা।
শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করার পর তার এ চার ঘনিষ্ঠ সহচরকে ৩ নভেম্বর কারাগারে হত্যা করা হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার জ্যেষ্ঠ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের রাজনৈতিক জীবনের সেখানেই ইতি ঘটে। পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। এর আগেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিন করা হয়। দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে জাতীয় চার নেতার স্ত্রী-সন্তানদের যথাযথ সম্মান, স্নেহ ও মর্যাদা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে বিদেশ থেকে নিয়ে এসে দলে স্থান দিয়েছিলেন। এক সময় তাকে দলের সাধারণ সম্পাদক করেন শেখ হাসিনা। তার ওপর অনেক নির্ভরশীলতা ছিল তার। তবে দলের অভ্যন্তরে অন্যদের সঙ্গে বিরোধের কারণে চার নেতার পরিবারের কেউ কেউ টিকতে পারেননি বলে অনুমান তাদের।
চার নেতার উত্তরসূরিরা কে কোথায় কী করছেন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এ চার নেতার অন্যতম ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কয়েক মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মন্ত্রীর দায়িত্বও সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার বিখ্যাত উক্তি ‘আওয়ামী লীগ একটা সংগঠন নয়, আওয়ামী লীগ একটি অনূভূতির নাম’ অনেক নেতাকর্মীকে আজো উজ্জীবিত করে। নেতাকর্মীরা মনে করেন, দুর্দিনে আওয়ামী লীগের হাল ধরা নেতা হলেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি আলোচিত এক-এগারোর সময়ে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। নির্লোভ রাজনীতিবিদ সৈয়দ আশরাফের প্রভাব ছিল নেতাকর্মীদের মাঝে। তিনি মারা যাওয়ার পর এ পরিবার থেকে আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে আসেন তার বোন সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। তিনি বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্য হলেও সৈয়দা জাকিয়া নূর দলে দাদা কিংবা ভাইয়ের মতো বলিষ্ঠ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। এ ছাড়া সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে হিসেবে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও তাকে খুব একটা চেনেন না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুজিবনগর সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। জাতীয় চার নেতার মধ্যে তাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেরা। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে তাজউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিনকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। এক সময় তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও হন। বয়সের কারণে ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
এরপর শেখ হাসিনা দলে নিয়ে আসেন তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজকে। দলে এসে প্রথমবার এমপিও হয়েছিলেন। পরে শেখ হাসিনা তাকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও করেন। রাজনৈতিক মহলে কথিত আছে, বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বনিবনায় টিকতে না পেরে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। তাজউদ্দিন আহমেদ রাজনীতিতে যেমন দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, সোহেল তাজ বাবার মতো রাজনীতিতে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। পরে তাজ সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এরপর দেশে ফিরে মানুষের ‘ফিজিক্যাল ফিটনেস’ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০২০ সালে ‘ইন্সপায়ার ফিটনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার বোন অর্থাৎ তাজউদ্দীন আহমেদের বড় মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি এখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। তাজউদ্দিন আহমেদ যে মাপের নেতা তার মেয়ে হিসেবে সেভাবে প্রভাব তৈরি করতে বা আলোচনায় আসতে পারেননি। তাজউদ্দীনের অন্য দুই মেয়ে শারমিন আহমদ ও মাহজাবিন আহমদ রাজনীতিতে আসেননি।
জাতীয় চার নেতার আরেক অন্যতম নেতা ক্যাপটেন এম মনসুর আলীর আলীর দুই ছেলের একজন ডক্টর মোহাম্মদ সেলিম এবং অন্যজন হলেন মোহাম্মদ নাসিম। ছাত্রজীবন থেকেই নাসিম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় আওয়ামী লীগে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। তার বড় ভাই মোহাম্মদ সেলিম আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তবে মোহাম্মদ নাসিমের মতো তিনি কখনো পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য থাকা অবস্থায় ড. সেলিম মারা যান। তবে মোহাম্মদ নাসিম দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করে গেছেন। বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি স্বরাষ্ট্র, গণপূর্ত, স্বাস্থ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। মনসুর আলীর উত্তরসূরি হিসেবে যথাযথ ভাবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোহাম্মদ নাসিম মৃত্যুবরণ করলে তার ছেলে তানভির শাকিল জয় আওয়ামী লীগ থেকে সিরাজগঞ্জের একটি আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় পর্যায়ে বাবার মতো পরিচিত নন তিনি। তবে রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তার কার্যক্রম সন্তোষজনক।
জাতীয় চার নেতার আরেক বর্ষীয়ান নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামানও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। তার ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র হয়েছেন। জাতীয়ভাবে না হলেও রাজশাহীর রাজনীতিতে তিনি ‘কিং’। বলা চলে ওই বিভাগের আওয়ামী লীগের রাজনীতির শক্ত ভিত গড়েছেন খায়রুজ্জামান লিটন। জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের সময় এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং তার ছোট ভাই ভারতের কলকাতায় একটি মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া করতেন। খায়রুজ্জামান লিটনের মেয়ে আনিকা সাদিয়া অর্ণা এরই মধ্যে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক উপসম্পাদক ও সহসম্পাদক ছিলেন।
তবে রাজনীতিক মহলের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন অনেকটাই প্রশাসন, পুলিশ, প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কমে এসছে। নতুন পরিস্থিতিতে আগের মতো করে নেতা তৈরি হওয়ার সুযোগ কম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারায় যে নেতৃত্ব তৈরি হবে, তাতে চার নেতার পরিবারের সদস্যরা কতটা সফল হবেন, তা দেখার বিষয়।