যে কারণে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে

হাবিবুর রহমান হাবিব।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব। ৯০-এর স্বৈরাচারী বিরোধী তুখোড় ছাত্র নেতা।  তার প্রস্তাবেই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য  গঠিত হয়। তার নেতৃত্ব, সাহস ও দক্ষতার কারণে অনেকে মনে করেছিলেন পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন তিনি। কিন্তু বিধিবাম। ঘটেছে উল্টোটা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে তিনি যোগ দেন বিএনপির রাজনীতিতে। বর্তমানে তিনি পাবনা জেলার আহ্বায়ক  ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। দ্য মিরর এশিয়া তার মুখোমুখি হয়েছিল কেন তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিলেন, এই জিজ্ঞাসার জবাব পেতে। তার জবাবের অংশটুকু পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-

 

হ্যাঁ, আমি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম উত্তাল দিনগুলোতে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সবশেষ পর্যায়ে এবং আমার প্রস্তাবেই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়েছিল। জিহাদের লাশটা আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক, জেনারেল এরশাদের পতন হলো, নির্বাচন হলো। আমি ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় আমাকে নমিনেশন দেয়া হলো। কিন্তু আমি যখন নমিনেশন জমা দিয়ে ফিরে আসলাম তখন আওয়ামী লীগের মধ্যেই ছাত্রলীগের সাবেক কিছু কুচক্রী নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনাকে বলে বসল, ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় কীভাবে নির্বাচন করে?

 

আমি বললাম, কামরুজ্জামান সাহেব প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় নির্বাচন করেছে। তো, সেদিন এই কুচক্রীমহল রাজি হয়নি এবং শেখ হাসিনাকে ভুল বুঝিয়ে আমার নমিনেশন বাতিল করে। আমাকে ছাত্র লীগের সভাপতির পদ থেকে রিজাইন দিতে বলে। তখন আমি পদত্যাগ করি। সেই সময় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, পরবর্তীকালে দু’বার দুটো মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। উনি তখন সরাসরি আমার আসনের এমপি, পরে মন্ত্রী হয়েছিলেন তার উপর নির্দেশ জারি করলেন, যেকোনো মূল্যে হাবিবকে হারাতে হবে। কারণ হলো, ১৯৮৯ সালে আমি যখন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হই তখন উনি (মোহাম্মদ নাসিম) আমার প্রচণ্ড আকারে বিরোধিতা করেছিলেন।

 

উনি অতীতে যখন যাকে সমর্থন করেছেন আমি সঙ্গে থেকেছি। একসময় যখন আব্দুল মান্নান ভাইকে সমর্থন করেছেন, আমি সাথে ছিলাম। যখন উনি সগীর আহমেদকে সমর্থন করেছেন, আমি তাকে সমর্থন দিয়েছিলাম। সগীর আহমেদ যখন চলে গেল, আর ছাত্র রাজনীতি করবেন না, তখন উনি (মোহাম্মদ নাসিম) আমার বিরোধিতা করতে লাগলেন। তার বিরোধিতার পরেও আমাকে ছাত্রলীগের সভাপতি করা হলো। সে কারণে আমার উপর তার রাগটা ছিল। উনি আমার কাছে পরাজিত হয়েছেন বলে ভাবতেন। ফলে উনি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। যদিও আমি তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করেছি। তারপরও তার মন ভরতো না। আন্দোলন তো শেষ হয়নি। আন্দোলন চলাকালীন বলতো, হাবিব ছাড়া আমাদের তো কিছু নাই। পরবর্তী সময়ে আমাকে যখন নমিনেশন দেয়া হলো— মোহাম্মদ নাসিমের সরাসরি বিরোধিতার কারণে, তার নির্দেশে এলাকার লোকজন বিদ্রোহ করার ফলে আমার পক্ষে নির্বাচনের ফলাফল আসেনি। পরবর্তীতে এসে এই বিরোধটা থেকেই গেল।

 

তখন বিএনপি ক্ষমতায় আসলো। আমার এলাকার আওয়ামী লীগের যে নেতা, উনি তার পক্ষ অবলম্বন করেই চলেছেন। আবার ১৯৯৬ সালে আমাকে নমিনেশন দিল। মোহাম্মদ নাসিম সরাসরি জিদ ধরে বসল; হাবীব ইলেকশন করলে আমি ইলেকশন করবো না। উনাকে ১৯৯৬ সালে নমিনেশন দেয়া হয়েছিল গাজীপুরের ১ ও ২ আসনে। উনি শেখ হাসিনাকে বলে বসলেন, হাবীবকে তিনটি সিটে নমিনেশন দিয়ে দেয়া হোক। আমি নির্বাচন করবো না। এটা নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে অনেক বিতর্ক হয়। তখন আমার নাম কেটে শামসুর রহমান শরীফ ডিকে নমিনেশন দেয়া হলো। বিনিময় ছিল শরীফের বড় ভাই কাস্টমস অফিসার উনাকে (মোহাম্মদ নাসিম) রাজাবাজার বাড়ি করার জন্য ১০লক্ষ টাকা দেন।

 

১৯৯৬ সালে প্রেসক্লাবের সামনে জনতার মঞ্চ করা হলো। তখন আমি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের অ্যাকটিং কনভেনর। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আমাকে একজন ফোন করে বিকেলে ডেকে নিয়ে গেলেন ৫নং রোডে ওয়াজেদ সাহেবের বাসায়। শেখ হাসিনা সেখানে থাকতেন। আওয়ামী লীগের যতো নেতা সবাই সেদিন উপস্থিত ছিলেন। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ওই যে হাবীব আসছে। ওবায়দুল কাদের একটা বক্তৃতা করল। বলল, এখন থেকে ছাত্র লীগের সকল দায়দায়িত্ব হাবিব পালন করবে। ‘ওকে’ কমিশন নামে একটা কমিশন ছিল। ওবায়দুল কাদের এই কমিশনের সদস্য। সেই থেকে আন্দোলনের টোটাল দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হলো। আন্দোলনের জন্য চেষ্টা করলাম। এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করলাম। ’৯০ সালে যেভাবে জমছে সেভাবে জমেনি। তখন সবাই মিলে আন্দোলন করেছিলাম। তারপর আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে কেউ কেউ টিটকারি করতো; একবার হিরো হয়েছে বলে দ্বিতীয়বারও হিরো হবে। নানান কাহিনি।

 

আক্তারুজ্জামান নামে এক লোক জাসদ করতো। উনি দলের বইটই ছাপিয়ে দিতেন। তার বাসা আমার বাসা পাশাপাশি। আমি তখন শংকরে থাকি। উনি বললেন, তোফায়েল ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি আন্দোলনের দায়িত্ব আপনার উপর দেয়া হয়েছে। কী করছেন জানি না, তবে যা-ই করেন সিরাজুল আলম খান দাদার সাথে একটু আলাপ করেন। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

 

সিরাজুল আলম খান তখন হোটেল শেরাটনে বসে থাকতেন। তার সাথে আলাপের আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। আমার সিদ্ধান্তও ছিল তাই। উনি বললেন, নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, জনগণ বিএনপির সাথে নেই। এই কথা এসে আমি শেখ হাসিনাকে জানাই। আপা বললেন, ঠিক আছে।

 

বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তত্ত্বাবধায়কের যে দাবি বিরোধীদলের; সে দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে বা দাবি পূরণ করতে হলে সংসদে তা বিল পাস করতে হবে। আওয়ামী লীগ তার আগেই পৃথিবীর জঘন্যতম যে ঘটনা, ১৯৯৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাগুরার একটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সদলবলে পদত্যাগ করে। সেসময় জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ওয়ার্কার্স পার্টি সবাই ছিল। তখন তো সংসদে পাস করার কোনো সুযোগ ছিল না। এই জন্য ম্যাডাম খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন নির্বাচন করে বিল পাস করে ক্ষমতা ছেড়ে দিবেন। সেই আলোকে নির্বাচন করা এবং তারা নির্বাচন করে কিন্তু সংসদে প্রথম অধিবেশনে বিলটা পাস করেছে। কিছুটা সময় লাগবে। আমি তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই জেলে।

 

মোহাম্মদ হানিফ তখন মেয়র। ঢাকার একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি। ঢাকার এতগুলো কমিশনার জেলে, আপনি কি বসে থাকবেন? তাদের মুক্তির জন্য একটা প্রোগ্রাম করেন। সমাবেশের আয়োজন করা হলো। আমি মোহাম্মদ হানিফকে বললাম, আমার বক্তৃতার পরে আপনার সভাপতির বক্তব্যের সময় আমার কথাকে সায় দিয়ে যাবেন। এখন সে কথা বলা যাবে না। বললে অনুষ্ঠান হবে না।

আমি বক্তৃতায় বললাম, যতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানা হবে না, ততদিন এই আন্দোলন চলবে। জনতার মঞ্চকে বিজয়ের মঞ্চে নিয়ে যাব। এই কথা আওয়ামী লীগের কেউ-ই চিন্তা করেনি। মোহাম্মদ হানিফ আমার বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা দিল। তখন মঞ্চের অনেকেই চিৎকার শুরু করে দিল। তারা এই কথা মানে না। তারা মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা বলল।আমি তখন বললাম, চিৎকার করো কেন? মোহাম্মদ হানিফ, হানিফই। এরপর সবাই চুপ। হাসিনার সাথে তার সদ্ভাব ছিল না। আওয়ামী লীগের সব নেতারা চলে গেলেন। তারা তো কেউ জানে না—এরকম একটা সিদ্ধান্ত আসবে। অপ্রস্তুত অবস্থা। মঞ্চে থাকলাম সর্বশেষ আমি, মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন মায়া চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, শাহজাহান খান। আর এদিকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি। মৃণাল কান্তিও ছিল।

 

যা হোক, সারা রাত অনুষ্ঠান চলতে থাকল। এর মধ্যে রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসি মজুমদার চলে আসল। গান বাজছে। প্যারোডি গান। সকালবেলা পুলিশ এসে মঞ্চ ভেঙে দিল। তারপর আবার লোকজন নিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হলো। সারাদিন সারা রাত চলল। ৩০ তারিখ ম্যাডাম জিয়া পদত্যাগ করলেন। ওই দিন মঞ্চে সভাপতিত্ব করছি আমি। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। ’৯০ সালেও শেষদিন মঞ্চে সভাপতিত্ব করেছিলাম আমি। এটাও আমার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটা অভিযোগ। ১৯৯০ সালেও ছাত্র আন্দোলনের পর অভিযোগ এসেছিল।

 

এরপর বিএনপির গণতন্ত্র মঞ্চ ভেঙে দিতে বলেছিল শেখ হাসিনা। আমি রাজি হইনি। শেখ হাসিনা বলল, তুমি যাচ্ছ না কেন? আমি বললাম, যে হাতে গণতন্ত্র নিয়ে এসেছি; সে হাতে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে পারব না। এটা করতে গেলে প্রাণহানি ঘটবে। নির্বাচন হবে না। সামরিক শাসন চলে আসবে। শেখ হাসিনা বললেন, তুমি আজীবন দায়িত্ব পালন করে আসছ; এখন বললেই হলো। এটা আমি করতে পারব না বলে বের হয়ে চলে আসছি। তখন আমার ওয়াইফকে বলতেছে, হাবীবের বউ, ও হাবীবের বউ ওকে থামতে বলো। আমি বের হয়ে গিয়েছিলাম। শুনে আবার এসে বললাম, আপা, হাত জোর করে বলছি— আমার স্ত্রীকে যদি ছেড়েও দিতে হয়; এই কাজ আমি করতে পারব না। এটাও আমার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ। এইগুলোর কারণে মতবিরোধ দেখা দিল। আমার নেতৃত্বের সময় যদি ছাত্র লীগের নেতা-কর্মীরা মারা যেত, তাহলে না হয় কথা ছিল। আমি ’৯০ সালে জোট করার কথা বলেছিলাম। তারা করেনি। জোট করলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেত। তাদের ভুলের সমস্ত দায়ভার আমার উপর চাপাল। আমার সাথে খারাপ ভাষা ব্যবহার করা হতো। গালাগালি করা হত। অব্যাহত অজুহাত দিতে লাগল। সত্যি কথা, ১৯৯০ সাল থেকেই শুরু হয়েছে এই মতবিরোধ।

 

জেনারেল এরশাদের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল। এরশাদ দলের অনেক লোক মেরেছে। ট্রাক চাপা দিয়েছে। তারপরও ১৯৯৬ সালে এরশাদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছে। এরশাদের সাথে যে সম্পর্ক ছিল তার প্রমাণ হলো এখন মহাজোট। পৃথিবীর কেউ পারে! কোনো মা পারে! বাবাও পারে না। মা- তো দূরের কথা! যেখানে সেলিম, দিলারাকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করল এরশাদ; সেই স্বৈরাচারী এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বানানো হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা জঘন্যতম। দলের কর্মীদের স্বৈরাচার মেরে ফেলল, ক্ষমতার লোভে সেই স্বৈরাচারীকে বিরোধী দলের নেতা বানাল। এরশাদ কিন্তু কবরে গেছে বিরোধী দলের নেতা হিসাবে।