‘ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতার হাত বদল নয় বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, গণ অভ্যুত্থানের চেতনা ও লক্ষ্য সুসংহত করতে হলে বিতাড়িত গণ বিরোধী শক্তিকে আইনের মুখোমুখি করার পাশাপাশি জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে প্রতিটি নাগরিকের ভোট প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) লন্ডন থেকে এক ভিডিও বার্তায় তিনি এসব কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, গণহত্যাকারী হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। তাই, দেশে জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এখনই সময়। লাঞ্ছিত-বঞ্চিত অধিকারহারা মানুষ একটি স্বাধীন, নিরাপদ এবং মর্যাদাকর জীবনের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। জনপ্রত্যাশা পূরণের জন্য একটি নিরাপদ এবং মানবিক বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময়। ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র মানবাধিকার ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গত ১৫ বছর ধরে গণতন্ত্রকামী মানুষ আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিল। আন্দোলন করতে গিয়ে এই সময়ে অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছেন, খুন হয়েছেন, অপহৃত হয়েছেন। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত ছাত্রজনতার ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানে গণহত্যাকারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের সাফল্য ও উদ্দেশ্য নস্যাৎ করে দিতে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উপর পরিকল্পিত হামলার ছক তৈরী করে দেশে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তবে হাসিনা পতন আন্দোলনের পক্ষের শক্তি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে বিতাড়িত অপশক্তি পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র কিন্তু এখনও থেমে নেই। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র—জনতার ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের চেতনা ও লক্ষ্য সু—সংহত করাই এই মুহূর্তের প্রধান অগ্রাধিকার।
তারেক রহমান বলেন, ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধুই রাষ্ট্র ক্ষমতার হাত বদল নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাষ্ট্র এবং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না গেলে রাষ্ট্র এবং রাজনীতির কাঙ্ক্ষিত গুণগত পরিবর্তন সম্ভব নয়। কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কারে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে টেকসই করতে হলে জনগণের ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ও গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে বিনীত আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আপনারা পরাজিত অপশক্তির পাতা ফাঁদে পা দেবেন না। ছাত্রজনতার গণ অভ্যুত্থানকে চূড়ান্ত সফলতায় নিতে হলে কেউ দখলদারিতে লিপ্ত হবেন না, দখলদারিতে সহায়তা করবেন না। কেউ দুর্বলের উপর আঘাত হানবেন না। কেউ আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না। প্রতিশোধ প্রতিহিংসা নয়, আসুন কার্যকর রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিত করতে তারুণ্যের কাঙ্ক্ষিত একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিই।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ আবু সাঈদ, মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, কলেজ ছাত্র ওয়াসিম আকরাম, মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন, স্কুল ছাত্র রিফাত হোসেন, ৬০ বছর বয়সী একজন মা মায়া ইসলাম, ৬ বছর বয়সী শিশু রিয়া গোপ, কিশোরী ছাত্রী নাঈমা সুলতানা, কুমিল্লার আইনজীবী আবুল কালাম, চুয়াডাঙ্গার রাজমিস্ত্রি উজ্জ্বল হোসেন, নোয়াখালীর দোকান কর্মচারী আসিফ, বরগুনার ওষুধ কোম্পানির সেলস ম্যান আল আমিনের মতো বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজারও মানুষ শহীদ হয়েছেন। অসংখ্য মানুষ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পাবনার গাড়ি চালক আরাফাত হোসেন, মিরপুরে গুলিবিদ্ধ ২২ বছর বয়সী মুস্তাকিম, দোকান কর্মচারী আতিকুল, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তামিমের মতো অনেকের হাত কিংবা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। শত শত মানুষ চোখ হারিয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন। অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে ৫ আগস্ট অর্জিত স্বাধীনতায় গণতন্ত্রকামী মানুষ আরো একবার স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করলেও হাসিনা পতন আন্দোলনে যেসব পরিবার তাদের সন্তান স্বজন হারিয়েছেন কিংবা আহতদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে যেসব পরিবারে অবর্ণনীয় দুর্দশা নেমে এসেছে, সেই সব বীর সন্তানদের ঘরে স্বাধীনতার স্বাদের ছোঁয়া লাগেনি।
তারেক রহমান বলেন, গণ অভ্যুত্থানে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরী করে প্রয়োজনীয় সহায়তার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যেই নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে গণ অভ্যুত্থানে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে সংবর্ধনা দেয়া হলে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানালে, কিছু সময়ের জন্য হলেও হতাহতদের পরিবারগুলো হয়তো একটু মানসিক সান্ত্বনা পাবেন। এ ধরনের উদ্যোগ গণ অভ্যুত্থানের চেতনা আরও শানিত করবে বলেও আমার বিশ্বাস।
তিনি প্রতি বছর ৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাতীয় জীবনের একটি বিশেষ দিবস হিসেবে সাড়ম্বরে পালন করার বিষয়টিও বিবেচনা করা দরকার বলে উল্লেখ করেন।
তারেক রহমান আরো বলেন, ২০১৮ সালেও সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। সেই সময় আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রীয় প্রতারণার শিকার হয়েছিল। গণহত্যাকারী হাসিনা আন্দোলনকারীদের নির্মমভাবে দমন করেছিল। এমনকি জালিম হাসিনা সেই সময় আহতদের চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। সুতরাং, দেরিতে হলেও ২০১৮ সালের হতাহত কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বর্তমানে রাষ্ট্র কীভাবে সহায়তা করতে পারে সেটিও বিবেচনায় নেয়া দরকার বলে আমি মনে করি। আমি বিশ্বাস করি, তারুণ্যের শক্তি, তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে কখনোই একটি রাষ্ট্র ও সরকার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না।
দেশের প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংশ্লিষ্টদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, গণহত্যাকারী হাসিনা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাহরণকারী হাসিনা পালিয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা আপনারা আপনাদের যার যার সংবাদপত্রে নির্ভয়ে এই শব্দটি লিখবেন 'হাসিনা পালিয়েছে'। 'হাসিনা পালিয়েছে' শব্দটির পরিবর্তে কোনো গণমাধ্যম যদি ভিন্ন শব্দ প্রয়োগের অপকৌশল নেন, সেটি জনগণের কাছে আপনাদের বিবেকের স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
তারেক রহমান আরো বলেন, ‘আপনাদের প্রতি আহ্বান গত ১৫ বছরে যারা গুম খুন অপহরণের শিকার হয়েছেন, ছাত্র জনতার বিপ্লবে হাজারো মানুষ যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন, তাদের এবং তাদের পরিবারের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করুন। 'সাগর রুনি'র হত্যা মামলার তদন্ত এক যুগেও কেন শেষ হলো না সেই প্রশ্ন তুলুন। জনগণ আপনাদের কাছ থেকে 'আয়না ঘর' নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট দেখতে চায়। হাসিনা দেশকে লুটেরা রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। জনগণ দুর্নীতির সেই সব চিত্র প্রতিদিন সংবাদপত্রে দেখতে চায়।’
‘গণহত্যাকারী হাসিনা প্রতিবার কীভাবে জনগণের ভোট ডাকাতি করেছিল, গণমাধ্যমে প্রতিদিন সেই সব চিত্র তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের আহ্বান জানাই। গণমাধ্যমে হাসিনার অপকর্ম ফ্রেমবন্দী থাকলে ভবিষ্যতে আর কেউ হাসিনার মতো ভোট ডাকাতি গণহত্যায় লিপ্ত হতে সাহস করবে না, যা গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করবে এবং ক্ষমতাসীনদের স্বৈরাচারী আচরণ থেকে বিরত থাকতেও বাধ্য করবে।’- বলেন তারেক রহমান।
সারা দেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী সমর্থক শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের পথ ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে। সেই নির্বাচনে জনগণের রায় পেতে জনগণের মন জয় করুন। জনগণের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা অর্জন করুন। জনগণের সুখে দুঃখে জনগণের সঙ্গে থাকুন, জনগণকে সঙ্গে রাখুন। ধর্ম বর্ণ পরিচয়ের কারণে কেউ যাতে অনিরাপদ বোধ না করেন, দায়িত্বশীল এবং জনপ্রিয় দল বিএনপির একজন নেতা-কর্মী ও সমর্থক হিসেবে সেটি নিশ্চিত করুন।
হাসিনা পতনের আন্দোলনে প্রবাসীদের ভূমিকা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, গণহত্যাকারী হাসিনা পতনের আন্দোলনে দেশে ছাত্র জনতার পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিশেষ অবদান রেখেছেন। দেশে যখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল, প্রবাসীদের মধ্যে একদল সাহসী মুখ প্রবাস থেকেই জনগণের সামনে হাসিনার দুঃশাসনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরে গণ আন্দোলনে শামিল থেকেছেন। প্রবাসে থেকেই হাসিনা পতনের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে কোনো কোনো প্রবাসী বাংলাদেশিকে প্রবাসে জেল জুলুম সইতে হয়েছে, হচ্ছে। তিনি ছাত্র—জনতার কাঙ্ক্ষিত একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও সংশ্লিষ্ট দেশের আইন মেনে সাধ্যমতো প্রবাসীদের যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।