ভুল স্বীকার করে বিএনপির প্রশংসা করলেন হাসান মাহমুদ
নিজেদের ভুল স্বীকার করে বিএনপির প্রশংসা করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের অন্যতম বড় ব্যর্থতা ছিল বিএনপিকে নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারা।
একইসঙ্গে তিনি বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে একমত হয়ে দলটির প্রশংসাও করেছেন। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা, জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ এবং সংস্কারের বিষয়ে তারেক রহমান ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্য নিয়েও প্রতিক্রিয়া জানান আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
তিনি বলেন, বিশেষ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব যে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার আমরা কারা?’- এই যে প্রশ্ন তুলেছেন, আমি এটির সঙ্গে একমত। এমনকি ছাত্রলীগকে কাগজে নিষিদ্ধ করার পর সেটির বিরুদ্ধেও তারা বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তাদের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত।
রোববার (৩ নভেম্বর) যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘চ্যানেল এস’-এর এক মতামতমূলক অনুষ্ঠানে ড. হাছান মাহমুদ গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রথমবার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন।
ছাত্র-জনতার তুমুল গণ আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাছান মাহমুদের দেশ ছাড়ার খবর এসেছিল। তবে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী ও দলের সংসদ সদস্যদের গ্রেফতার অভিযানের মুখে তিনি কীভাবে বাইরে গেলেন, সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে এখনো।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ শাসিত সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল বা ব্যর্থতা কী ছিল- এমন এক প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, সরকারে থাকলে ভুল হবেই। পৃথিবীর কোনো সরকার শতভাগ নির্ভুল কাজ করতে পারবে না। আমাদেরও অনেক ভুল ছিল। শুধু একটি দুটি ভুল নয়, দায়িত্বে থাকলে ভুল হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- এটি আমার দলের অভিমত নয়, ব্যক্তি ড. হাছান মাহমুদের অভিমত হচ্ছে…আমি মনে করি বিএনপি অবশ্যই সব সময় নির্বাচন বর্জন করেছে, নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু যেহেতু আমরা দায়িত্ব ছিলাম, বিএনপিকে নির্বাচনে অ্যাকোমোডেট করতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা ছিল। ২০১৪ সালে, ২০২৪ সালে নির্বাচনে আনতে না পারা আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ছিল। যদিও তারা আমাদেরকে ব্যর্থ করার চেষ্টাই করেছে, তবুও এটা আমাদের ব্যর্থতা।
অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার তীব্র প্রতিবাদ জানান এই আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বলেন, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আমি বিএনপির দায়িত্বশীলদের বক্তব্য দেখেছি। তারাও এটার বিরোধিতা করেছে। কোনো রাজনৈতিক দলকে কাগজে কলমে নিষিদ্ধ করলেও কিন্তু সেটি নিষিদ্ধ হয়ে যায় না।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর যখন প্রথম নির্বাচন হয়, সেভেন্টি নাইনে যখন পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়- আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেকের মতে কমে গিয়েছিল তখন। সেই সময় আওয়ামী লীগ ৩৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। এখন একেবারে কমপক্ষে বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের কথা যারা ভাবেন সেটি অলীক একটি কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।
তিনি আরো বলেন, যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সৃষ্টি এবং দেশের বহুবিধ অর্জন সম্ভব হয়েছে, সেই দলকে নিষিদ্ধ করার চিন্তাধারা কীভাবে এবং কেন আসে, তা বোধগম্য নয়।
হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হয়েছে। কারও কারও মতে এই সমস্ত মামলার আসামি ৬ মিলিয়ন। তৃণমূল পর্যায়ের ওয়ার্ড লেভেলের কর্মীর বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হচ্ছে পুলিশ দিয়ে। তারা ঘর বাড়িতে থাকতে পারছে না। আমাদের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড হত্যাকাণ্ড যে বলছে, হত্যাকাণ্ড তো এখনো চলছে। এগুলোকে হত্যাকাণ্ড মনে করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে পুলিশকে যখন আক্রমণ করা হয়, পুলিশের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই? আত্মরক্ষার্থে পুলিশ তখন গুলি ছোঁড়েনি তা নয়, অবশ্যই ছুঁড়েছে। সেজন্য পুলিশের দায় আমরা কখনো অস্বীকার করিনি বা সরকার পক্ষের দায় আমরা কখনো অস্বীকার করিনি। এখনো অস্বীকার করছি না। অবশ্যই দায়িত্বে থাকলে দায় নিতে হবে। সেই দায় থেকেই শেখ হাসিনা সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। ৫ আগস্টের আগে আমাদের বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। সেটির ডাটা আমরা তৈরি করছি, প্রকাশ করা হবে।
সাবেক এই মন্ত্রী আরো বলেন, মৃত্যুর যে সংখ্যা-তথ্য দেওয়া হচ্ছে সেটি আসলে কত? সেটি নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। আসলে কতজন হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছে সেই নামটা প্রকাশ করুক। আমি মনে করি, প্রথম থেকেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের যে দাবি ছিল, সেই বিষয়টি পুরোপুরি আদালতের হাতে ছেড়ে না দিয়ে যদি বিষয়টি অন্যভাবে হ্যান্ডেল করা যেত তাহলে ভালো হতো। এটিকে এতদূর যেতে দেওয়াটাই ভুল ছিল আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
দলের পরবর্তী নেতৃত্ব প্রসঙ্গে হাছান মাহমুদ বলেন, দলে সব সময় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনাই প্রাণ এবং শেখ হাসিনা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রাণ ভোমরা। তাকে ছাড়া আওয়ামী লীগ কল্পনা করা যায় না। দলে গণতন্ত্র আছে তাই কোনো লাইনআপ তৈরি করা নেই। সময় এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরি হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত। ১/১১ সরকারের সময় বিএনপির সঙ্গে একজোট হয়েই আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম করেছিলাম এবং গণতন্ত্র ফিরে এসেছে। এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান সাহেব কিংবা বিএনপির মহাসচিব জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব যে বক্তব্যগুলো দিচ্ছেন সেগুলোর অনেকগুলোর সঙ্গে আমি একমত। গতন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য যদি প্রয়োজন হয়, অবশ্যই বিএনপির সঙ্গে একযোগে কাজ করতে আমরা তৈরি আছি, এক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত নেই। তারা রাষ্ট্রপতি ইস্যু থেকে শুরু করে দেশে যেন সাংবিধানিক সংকট তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে তাদের যে স্ট্যান্ড সে ব্যাপারে আমি অ্যাপ্রিশিয়েট করি। জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ হওয়ার পর বিএনপির যে বক্তব্য সেই বক্তব্যের সঙ্গেও আমি একমত। একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়ে, রাজনৈতিক দলের অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হলো এ নিয়ে সরকারের কোনো বক্তব্য পাচ্ছি না। অত্যন্ত হতাশ হচ্ছি, আমরা কোন দিকে যাচ্ছি।
মনে রাখতে হবে, কোনো সরকারই কিন্তু শেষ সরকার নয়- এ কথা উল্লেখ করে সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরাও কিন্তু শেষ সরকার ছিলাম না। অনেকে মনে করেনি, সেটা সঠিক। কিন্তু আমি সব সময় মনে রেখেছি। ফলে এই সরকারই শেষ সরকার নয় সেটা মনে রাখতে হবে। তারা যে আগের সরকারের মন্ত্রীদের হাতকড়া পরালেন, ডিম ছুঁড়লেন- ভবিষ্যতের যে ভয়ংকর একটা উদাহরণ তৈরি করে গেলেন, ভবিষ্যতে কী ঘটে সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং আমি বিএনপির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে একমত এবং বিএনপি যে গণতন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের কথা বলছে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে সেটির সাথে আমরা একমত। প্রয়োজনে বিএনপির সঙ্গে আমরা একযোগে গণতন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা কাজ করবো।
তিনি বলেন, আমরা চাই দেশ ভালো থাকুক। আজকে জাতীয় জীবনে হতাশা নেমে এসেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বাংলাদেশে একটি আপার হাউজ দরকার, এতে অনেক কোয়ালিটিফুল মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন। এ ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও বক্তব্য রেখেছেন, তিনিও আপার হাইজের পক্ষে বলেছেন। আমি খোলাসা করে বলছি- এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটি আমার দলের অভিমত নয়।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রের অনেকগুলো সংস্কার দরকার। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব যেটি বলেছেন আমি তার সঙ্গে শতভাগ একমত। আমি মনে করি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই রাষ্ট্র সংস্কার হওয়া প্রয়োজন।
দেশে ফিরে আসার সুযোগ হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখনোই নয়। আমি মনে করি আমার দলও প্রতিহিংসামূলক আচরণ করার পক্ষপাতী নয়। কেউ খারাপ উদাহরণ তৈরি করলে সেই খারাপ উদাহরণকে অনুসরণ করতে নেই।
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমার দলের নেতাকর্মীদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। পঁচাত্তরের পরে কঠিন সময় গেছে এবং দল ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দল পরপর ৪ বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেছে। নেতাকর্মীদের ওপর আজকে যে নির্যাতন, নিপীড়ন হচ্ছে…তাদেরকে বলবো এই আঁধার কেটে যাবে এবং সহসা দেশে একটি সুষ্ঠু, স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন, সবার সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখছেন। তার মনোবল শতভাগ চাঙ্গা আছে। নেতাকর্মীদের বলব, যখন এই আঁধার কেটে যাবে তখন আমরা সবার প্রতি সহনশীল আচরণ করবো। অবশ্যই রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা সেই ভুলগুলো স্বীকার করছি। ভুল থেকেই মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে।