পুরান ঢাকার হকিকে জাগ্রত রেখেছিলেন ‘ওস্তাদ ফজলু’
পুরান ঢাকাকে বলা হয় বাংলাদেশ হকির আঁতুড় ঘর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এলাকাটি থেকে উঠে এসেছেন অসাধারণ সব খেলোয়াড়। অনেক আগেই হকির গ্ল্যামারে ভাটা পড়লেও পুরান ঢাকা থেকে খেলোয়াড় ওঠে আসার ধারায় কখনো ছেদ পড়েনি। যারা এর নেপথ্যে ছিলেন, তাদের অন্যতম ফজলুল হক। ‘ওস্তাদ ফজলু’ নামেই যিনি ছিলেন সমাধিক পরিচিত।
দেশের হকির কত কিংবদন্তির খেলাটার প্রথম পাঠ যে তার কাছে। হকি অন্তপ্রাণ এই মানুষটি গতকাল বুধবার হঠাৎই সব ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। তাকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ হকি অঙ্গন। বিশেষ করে পুরান ঢাকার হকি খেলোয়াড়দের মনে হাহাকারের সুর।
দেশের হকির অন্যতম সুপারস্টার রফিকুল ইসলাম কামাল যেমন বলছেন, ‘পুরান ঢাকার হকিটাকে উনিই ধরে রেখেছিলেন। আমি জানি না এখন পুরান ঢাকার হকিটা কীভাবে চলবে। এই যে একটা ধারা ছিল, এটা কীভাবে চলমান থাকবে। ফজলু ভাইয়ের শূন্যতা আমরা পূরণ করতে পারব কি না, আমি জানি না। আমার মনে হয় ফজলু ভাই এমন এক হকি ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যার শূন্যতা কাউকে দিয়ে পূরণ হওয়ার নয়।’
কামাল বলেন, তার হকি খেলোয়াড় হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদানও ফজলুল হকের, ‘সম্পর্কে ফজলু ভাই আমার চাচাত ভাই। তার সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আমাকে তিনিই প্রথম হকিতে নিয়ে আসেন। আমার পরিবারের অনেকেই চাইতো না আমি খেলাধুলা করি। আমি যখন ফজলু ভাইয়ের সঙ্গে খেলাধুলা শুরু করলাম, মাঠে যাওয়া শুরু করলাম, তখন ফজলু ভাইকে আমার পরিবারের সবাই অপছন্দ করা শুরু করে। ফজলু ভাইয়ের সঙ্গে যেন আমি না মিশি, সে ধরনের কথাও বলেছেন। কিন্তু ফজলু ভাই এমনই ছিলেন, আমাকে বাসায় এসে উঠিয়ে নিয়ে যেতেন মাঠে। তার খেলোয়াড়ি সরঞ্জাম সবই আমাকে দিতেন।’
শুধু কামাল নন, মাকসুদ আলম হাবুল, রাসেল মাহমুদ জিমি থেকে শুরু করে এই সময়ের নাঈম উদ্দিন, আরশাদ হোসেনরাও ফজলুল হকের কাছে হকি অনুশীলন করতেন। ছোট ছেলেদের বাসা-বাড়ি থেকে ধরে এনে হকি শেখাতেন তিনি। অভিভাবকরা রাজি না হলে তাদের বোঝাতেন। খেলার সরঞ্জামেরও ব্যবস্থা করে দিতেন তিনি। আরমানিটোলা স্কুল মাঠের একপাশে ছিল তার হকি অনুশীলন করার জায়গা। যার দেয়ালে লেখা থাকত, ‘ওস্তাদ ফজলুর মুখের বুলি, এসো সবাই হকি খেলি’। করোনাকালে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও থেমে থাকেনি ওস্তাদ ফজলুর কার্যক্রম। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাড়ির ছাদে হকি শিখিয়েছেন তিনি।
এই সময়ের হকির সবচেয়ে বড় তারকা রাসেল মাহমুদ জিমি তাই বলছেন, ‘পুরান ঢাকার বাচ্চাদের নিয়ে তিনি যেভাবে প্র্যাকটিস করাতেন, শেখাতেন, এটা ভাবা যায় না। এই সময়ে অনেকেই হকির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু উনি আগ্রহটা জাগিয়ে রেখেছিলেন। অনেক ভালো ভালো খেলোয়াড় এখান থেকে তৈরি হয়েছে। তিনি নিজেও প্রথম বিভাগে খেলেছেন। অনেক কষ্টও করেছেন। এখন হয়তো দেখা যাবে খেলোয়াড় তৈরি হবে, কিন্তু একটা যে প্ল্যাটফর্ম ছিল, সেটা আর থাকবে না। কারণ এটা কে কন্টিনিউ করবে? উনি তো ওনার জীবনের সবকিছু বাদ দিয়ে হকির পেছনেই ছিলেন।’
আসলেই তাই। জীবনে কি পেলাম, এ নিয়ে কখনো ভাবেননি তিনি। বিয়েও করেছেন দেরিতে। অর্থ কষ্টেই দিন কাটাতেন। তবু সারা দিন পড়ে থাকতেন হকি নিয়ে। গত বছর শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়ে যেমন বলেছিলেন, ‘এই টাকায় ঘরে টিভি-ফ্রিজ আনব। কিছু দেনা পরিশোধ করব।’
ওস্তাদ ফজলু এক সময় নিজেও হকি খেলতেন। হকির ‘টাইগার’ খ্যাত আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়ার হাত ধরে ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বিভাগ দিয়ে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। খেলেছেন ২০০৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু কখনো জাতীয় দলে খেলা হয়নি। ১৯৮৪ সালে মালয়েশিয়ায় জুনিয়র বিশ্বকাপে ডাক পাওয়ার কথা ছিল। চোখে আঘাত পাওয়ায় আর সেটা হয়নি।
কিন্তু একটা স্বপ্নের মৃত্যু হলেও অন্য আরেকটা স্বপ্নের শুরু ছিল আসলে সেখানেই। নিজের না পারার দুঃখ ঘোচাতে তরুণ বসয়ে নেমে পড়েছিলেন খেলোয়াড় তৈরির সংগ্রামে। যেখানে একজন আলোর ফেরিওলা হয়ে উঠেছিলেন ‘ওস্তাদ ফজলু’।
গতকাল সকালে বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে ৬০ এর কাছাকাছি পৌঁছানো ‘ওস্তাদ ফজলু’কে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে বাদ আসর আরমানিটোলা তারা মসজিদে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।