গৃহবন্দি রোমের কমিউনিটি নেতা বাচ্চু, কাদেরের দাবি মিথ্যা মামলা
ইতালির রাজধানী রোমের বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চু গ্রেপ্তার হয়েছেন গত ১১ এপ্রিল। ভোর সাড়ে তিনটায় বাচ্চুর রোমস্থ বাসা ঘেরাও করে ইতালির জননিরাপত্তায় নিয়োজিত সামরিক শাখার বিশেষ বাহিনী কারাবিনিয়েরি। চাঁদাবাজি, অপহরণ, প্রতারণা এবং মাদক ব্যবসাসহ কয়েকটি অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চুর রোম প্রবাসী ভাই আবদুল কাদের রিটন জানান, তার ভাই বাচ্চুর মুক্তির জন্য আইনি প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রোমের কয়েকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশি কমিউনিটি। এর মধ্যে গত ১ ও ২৬ মে রোমে দুটি বড় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে স্থানীয় রাজনীতিক এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির উদ্যোগে।
কাদের জানান, তারা একাধিক আইনজীবীর পরামর্শে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আবেদনের ভিত্তিতে গত ২ মে আদালত বাচ্চুকে কারাগার থেকে বাসায় স্থানান্তরের অনুমতি দেয় এবং ৯ তারিখ থেকে তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন।
কাদের বলেন, ২০২২ সালে রোমের দুজন বাংলাদেশি অভিবাসীর মধ্যে আদম ব্যবসার অর্থ লেনদেন নিয়ে ঝামেলা হয়। কমিউনিটি নেতা হিসেবে বাচ্চুর কাছে তারা যান সামাজিক বিচারের জন্য। বাচ্চু উভয়ের কথা শুনে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান দেন। যা তখন উভয়ই মেনে নেয় এবং দেনাদার অর্থ ফেরত দিতে রাজি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সে অর্থ ফেরত দেয়ার পরিবর্তে টালবাহানা করতে থাকে। ফলে বিষয়টা নিয়ে আরো কয়েক দফা দেন-দরবার হয় এবং কিছু টাকা উদ্ধার হয়।
পরবর্তীতে দেনাদার নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চুর নামে চাঁদাবাজি, অপহরণ, প্রতারণা এবং মাদক ব্যবসার অভিযোগ তুলে একাধিক মামলা করেন। বলা হয়- বাচ্চু টেলিফোনে তার কাছে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেয়ায় তাকে কভিডের সময়ে অপহরণ করে আটকে রাখেন। নির্যাতন করেন।
অভিযোগে আরো বলা হয়- বাচ্চু ধূমকেতু অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে মুসলিম কবর প্রজেক্টের নামে মানুষের সাথে প্রতারণা করেন। রোমের তরপিনাতারা এলাকায় যত মাদক ব্যবসা হয়, তা তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন।
মুন্সিগঞ্জ, শ্রীনগরের নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চু ৩৪ বছর যাবৎ রোমে বসবাস করেন। ৩ কন্যা সন্তানের পিতা বাচ্চু রোমের বাংলাদেশি কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন রোমের সাবেক সভাপতি। রোমের সবচেয়ে বড় সামাজিক সংগঠন ধূমকেতুর প্রতিষ্ঠাতা এবং আইন উপদেষ্টা।
১৯৯৫ সাল থেকে রোমে অভিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোর প্রথম সারির নেতা ছিলেন বাচ্চু। তাকে অনেকে রাজপথের নেতা হিসেবেই চেনেন। অভিবাসীদের স্বার্থ বিরোধী কিছু হলেই তিনি রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে ১৯৯৮ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে অভিবাসীরা যে স্থানীয় ডকুমেন্ট পেয়েছিলেন, সেটাকে অনেকে ‘বাচ্চুর সৌজন্য’ বলতেন।
২০১৬ সালে পুলিশ নিরাপত্তার অভিযোগে রোমের তিনটি নামাজের স্থান বন্ধ করে দিলে বাচ্চুর নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। রোমের প্রতীক এবং বিশ্বের সাত আশ্চর্যের অন্যতম কোলাসিয়ামসহ রোমের অন্তত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ খোলা চত্বরে হাজার হাজার মুসল্লি নিয়ে তিনি জুমার নামাজ আদায় করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
তিনি ইতালির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমান পরিবহন মন্ত্রী মাত্তেয়ো সালভিনির সাথে লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে ব্যাপক তর্কে জড়িয়েছিলেন, যা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে সমালোচিত হয়েছিল।
বাচ্চু ইতালির মসজিদের ইমাম এবং মুয়াজ্জিনের কাজকে ‘কাজ’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি তুলে বলেছিলেন, এই কাজের জন্য ‘ওয়ার্ককোড’ ঘোষণা করতে হবে। ওয়ার্ককোড না থাকলে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা তাদের কাজের স্বীকৃতি পান না। পেশাগত কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। এমনকি তারা ডকুমেন্টও নবায়ন করতে পারেন না।
তিনি প্রতিটি শহরে মুসলিম কবরস্থান নির্মাণের দাবি তুলেছিলেন। সরকারি বেসরকারি সকল হাসপাতাল ক্লিনিকে মুসলিম শিশুদের (ছেলে) জন্য খৎনার ব্যবস্থার দাবি তুলেছিলেন। মুসলমানদের ধর্মীয় বড় উৎসব- দুই ঈদে সরকারি ছুটি এবং মসজিদে ধর্মীয়ভাবে বিয়ে পড়ানো হলে তার আইনগত স্বীকৃতির দাবি তুলেছিলেন। তিনি প্রথম ইতালিতে খোলা মাঠে ঈদের নামাজের আয়োজন করেন।
বাচ্চু দীর্ঘদিন যাবৎ রোমে একটি মুসলিম কবরস্থান নির্মানের চেষ্টা করছেন। তিনি রোমের আদালতে দোভাষীর কাজ করেন। আইনি জটিলতায় পড়া প্রবাসীদের তার সংগঠন 'ধূমকেতু'র মাধ্যমে সহযোগিতা দেন। অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন।
সব মিলিয়ে অনেকে মনে করেন, ইতালির বাম ধারার রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা বাচ্চু বর্তমান ডানপন্থী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। তাকে নিয়ে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো ব্যাপক বাড়াবাড়ি করেছে। তার বিরুদ্ধের অভিযোগ অন্তত প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাকে মিডিয়া ট্রায়ালে আনা হয়েছে, যা সাধারণত ইতালিতে হতে দেখা যায় না।
এ বিষয়ে বাচ্চুর ভাই আবদুল কাদের রিটন কোনো মন্তব্য না করে বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই প্রশাসনকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার সংস্কৃতি আছে। ইতালিতেও থাকতে পারে, কিন্তু আমরা (বাচ্চুর পরিবার) ইতালির বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল এবং আমরা বিশ্বাস করি সুবিচার পাব।
তিনি দাবি করেন, বাচ্চুর বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট মামলা দেয়া হয়েছে, যা বিচারিক আদালতে টিকবে না। যে কারণে আদালতে আমার ভাইর জন্য জামিনের আবেদন করিনি, সুষ্ঠু বিচার চেয়েছি।
কাদের বলেন, গভীর রাতে বাসা ঘেরাও করে আটক করার মতো ক্রিমিনাল আমার ভাই না। তবু তাকে গ্রেপ্তারের সাথে সাথে স্থানীয় মিডিয়ার অতিউৎসাহ, বাড়াবাড়ি রকমের খবর প্রচার এবং সোস্যাল মিডিয়ায় কয়েকজনের দায়িত্বহীন মন্তব্য আমরা আদালতের দৃষ্টিতে এনেছি। তাদের নামে উকিল নোটিশ করেছি। এর মধ্যে দুজন বাংলাদেশিও আছেন।
৯০ এর দশক থেকে রোমের বাংলাদেশি কমিউনিটির সকল ভালো কাজের সাথে আমার ভাই জড়িত ছিলেন। আজ তার দুর্দিনে কমিউনিটির সহযোগিতা, সমর্থন আমরা পাচ্ছি। অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করছেন। খোঁজখবর রাখছেন। বাচ্চুর পরিবারের পক্ষ থেকে সবার প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করছি- যোগ করেন কাদের।