নরেন্দ্র মোদির 'ভালো বন্ধু' জর্জিয়া মেলোনি

নরেন্দ্র মোদির 'ভালো বন্ধু' জর্জিয়া মেলোনি

সালটা ১৯৯৬, মাত্র ১৯ বছর বয়স তখন তার। উগ্র দক্ষিণপন্থী এক যুব দলের কর্মী; সামনে একটা ফরাসি টিভি ক্যামেরা। তার সামনে দাঁড়িয়ে সদ্য কৈশোর পেরনো তরুণী জর্জিয়া মেলোনি লুকোছাপার কোনও চেষ্টাই করেননি।

সটান বলে দিয়েছিলেন, 'আমি মনে করি মুসোলিনি খুবই ভাল রাজনীতিক ছিলেন। যা করেছেন, সব ইতালির জন্য করেছেন। গত পঞ্চাশ বছরে আমরা এমন একজন রাজনীতিবদকে পাইনি!' 

দলটির নাম 'মুভিমেন্তো সোশ্যালে ইতালিয়ানো' বা এমএসআই, ইংরেজিতে হয় 'ইতালিয়ান সোশ্যাল মুভমেন্ট'। আজ সেই দলের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলে একটু একটু করে উঠে দাঁড়াচ্ছে ইতালি। অথচ সমাজের নানা অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেনিতো মুসোলিনির মতাদর্শ। সেই ছায়া থেকেই তৈরি হয়েছিল এমএসআই। আড়াল-আবডাল থেকে প্রকাশ্যে উগ্র দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের সমর্থকরা জড়ো হয়েছিলেন তাতে। তাদের সঙ্গে ছিলেন সদ্য কৈশোর পেরোনো জর্জিয়া মেলোনি।

অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। রোমের দক্ষিণে গারবাতেলা অঞ্চলে ১৯৭৭ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্ম মেলোনির। মোটামুটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত এলাকা। এখনও এখানে দক্ষিণপন্থীদের চাইতে মধ্য বা বামপন্থীরাই বেশি ভোট পান। মেলোনির বাবা ফ্রান্সেসকো মেলোনি বস্তুত ছিলেন ঘোর বামপন্থী। ভোট দিতেন ইতালির কমিউনিস্ট পার্টিকে। কিন্তু মেলোনির জন্মের পরেই ফ্রান্সেসকোর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় মেলোনির মা আনা পারাতোরের। কী কারণে এই বিচ্ছেদ, ঠিক জানা যায়না। আনারও দক্ষিণপন্থী মতামত ছিল। কিন্তু জানিয়েছেন, মেয়ের ওপর সেসব তিনি চাপাননি। পরে এমএসআইয়ের উত্তরসূরি অ্যালেয়াঞ্জা নাজিওনালে বা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের ছাত্র সংগঠনের শীর্ষে আসেন তরুণ নেত্রী মেলোনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির 'ভাল বন্ধু' হিসেবে জর্জিয়া মেলোনি এখন আসমুদ্রহিমাচলের সমাজমাধ্যমে রীতিমত ট্রেন্ড করছেন। জো বাইডেন থেকে ঋষি সুনাক, সব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ভালই সুসম্পর্ক রেখে চলেন মোদি। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ভ্লাদিমির পুতিন, দু'পক্ষের সঙ্গেই আলোচনায় বসেছেন মোদি। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গেও তার বেজায় ভাল সম্পর্ক। কিন্তু জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে মোদির হৃদ্যতা এর মাঝেও খানিক আলাদা। দুবাইতে গত জলবায়ু সম্মেলনের বৈঠকের ফাঁকে মোদির সঙ্গে সেলফি তুলে মেলোনি দুই রাষ্ট্রনায়কের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে লিখেছিলেন 'মেলোডি'। তার পর থেকে 'মেলোডি' রীতিমত ভাইরাল। জি৭ বৈঠকে মোদি রওনা হতেই নেটদুনিয়া অধীর আগ্রহে বসেছিল, কখন 'মেলোডি'র দেখা পাওয়া যায়। নেটনাগরিকদের সে আশা মেটাতে এবার রীতিমত একটি ছোট্ট ভিডিও পোস্ট করেছেন মোদি-মেলোনি। সহাস্য মোদির পাশে দাঁড়িয়ে মেলোনি বলেছেন, 'হ্যালো ফ্রম দ্য মেলোডি টিম...' ।

সমালোচকরা অনেকেই বলেন, মেলোনি ও মোদির এই বন্ধুত্বের একটা বড় কারণ, দু'জনের প্রায় একইরকম চিন্তাভাবনা। দুই রাষ্ট্রনায়কই বিশ্বের অন্যতম তাবড় দক্ষিণপন্থী মুখ বলে পরিচিত। দু'জনেই নিজের দেশে প্রবল জনপ্রিয়। এবারে নরেন্দ্র মোদিরর বিজেপির ভোট সামান্য কমে থাকতে পারে। কিন্তু তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে কোনও অসুবিধে হয়নি তার।

ওদিকে ইউরোপীয় সংসদের নির্বাচনে মেলোনির দলের জয়জয়কার। একদিকে ফ্রান্সের ইম্যানুয়েল ম্যাক্রোঁ মুখ থুবড়ে পড়েছেন, ব্রিটেনের ঋষি সুনকের কনজারভেটিভ দল সামনের নির্বাচনে জিতবে কিনা ঠিক নেই। কিন্তু ইতালিতে মেলোনি ও জার্মানিতে নব্য নাৎসি ভাবধারায় দীক্ষিত দল এএফডি (অল্টারনেটিভ ফর ডয়শেল্যান্ড) রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছে। মেলোনি নিজেকে গর্বিত খ্রিস্টান বলেন, মোদীও ভোটের আগে উগ্র হিন্দুত্বের প্রচারে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন।    

ইউরোপীয় মানচিত্রে এমনিতে রক্ষণশীল দেশ বলে পরিচিত ইতালি। ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির চাইতে আর্থিকভাবেও কিঞ্চিৎ পিছিয়ে ইতালি। দেশে লাগামছাড়া মাফিয়া রাজের সমস্যা আছে। অপরাধের হার বেশি। দারিদ্র্য, অসাম্য সবেতেই ইতালি বাকি পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর চাইতে পিছিয়ে। রাজনৈতিকভাবেও বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালি অত্যন্ত অস্থির। এককালে যে অঞ্চল থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্য শাসন করত উত্তর আফ্রিকা থেকে পশ্চিম এশিয়া, সেই ইতালিতে ১৯৪৬ সালের পর থেকে ৬৯ বার সরকার বদল হয়েছে। অথচ একবারও একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী পায়নি ইতালি। ৪৫ বছরের মেলোনিই ইতালির প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী।

১৯৯৮ সালে প্রথম রোম প্রদেশের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন মেলোনি। ২০০২ অবধি ওই পদে ছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে প্রথমবার ইতালীয় সংসদের নিম্নকক্ষ 'চেম্বার অফ ডেপুটি'-তে নির্বাচিত হ'ন মেলোনি। সেবার ভোটে বাম জোটের প্রার্থী রোমানো প্রোডির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হেরে যান বিখ্যাত মিডিয়া মোগল সিলভিও বার্লুস্কোনি। মাত্র দু'বছরের মধ্যেই অবশ্য অনাস্থা ভোটে সরকার পড়ে যায়। ফের নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। এবারে ক্ষমতায় আসেন বার্লুস্কোনি। মাত্র ৩১ বছর বয়সে সেই সরকারের অধীনে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স জোটসঙ্গী হিসেবে যুবকল্যাণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পান জর্জিয়া মেলোনি। ২০১১ অবধি ওই পদে ছিলেন মেলোনি। প্রধানমন্ত্রীত্বের আগে জীবনে ওই একবারই সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন।

২০১২ সালে প্রথম নিজের দল গড়েন মেলোনি। নাম রাখেন ফ্রাতেল্লি দে ইতালিয়া বা 'ব্রাদার্স অফ ইতালি'। ততদিনে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স মিশে গিয়েছে বার্লুস্কোনির ফোর্জা ইতালিয়া বা 'ফরোয়ার্ড ইতালি' দলে। ২০০৯ সালের কথা।

এদিকে সমালোচকরা বলেন, মুসোলিনির পরে সম্ভবত ইতালির সবচেয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থী মতবাদের আখড়া হয়ে দাঁড়ায় ব্রাদার্স অফ ইতালি। দলের প্রতীকেও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দলের ছাপ রয়েছে। অনেকে গাঁইগুঁই করেছিলেন। মেলোনি কান দেননি। অবশ্য তিনি যে আদৌ মুসোলিনির পথের পথিক নন, সেটা জানাতে কোনও কসুর করেন না মেলোনি। বলেন, তাঁর দলের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের কোনও যোগ নেই। তিনি সবার প্রধানমন্ত্রী। ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে আসা নিয়েও তাঁর বিশেষ উচ্চবাচ্য নেই। সাফ বলে দিয়েছেন, বিদেশনীতির ক্ষেত্রে কোনও বড় বদল তিনি আনবেন না। এদিক দিয়ে তিনি অবশ্য তার পূর্বসুরি বার্লুস্কোনি বা মাতেও স্যালভিনির চাইতে খানিক আলাদা। দু'জনেই রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোর অনুরাগী ছিলেন। মেলোনি সেখানে জি৭ বৈঠকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভলোদিমির জেলেনস্কিকে।

কিন্তু রক্ষণশীলতার ক্ষেত্রে আবার মেলোনি আপোসহীন। ইউরোপের অন্যান্য রক্ষণশীলদের মতোই মেলোনি সমকামিতা, ইসলাম ও পরিযায়ীদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। তাঁর মতাদর্শ বোঝাতে গত বছরের জুনে স্পেনে এক বক্তৃতার অংশই যথেষ্ট। যেখানে মেলোনি বলেছিলেন, 'আমি স্বাভাবিক পরিবারের পক্ষে, এলজিবিটি লবির বিপক্ষে; যৌন পরিচিতির পক্ষে, লিঙ্গ মতবাদের বিপক্ষে, ইসলামী হিংসার বিরুদ্ধে, সীমান্তকে সুরক্ষিত করার পক্ষে, মাইগ্রেশনের বিপক্ষে, ব্রাসেলসের (ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর) আমলাতন্ত্রের বিপক্ষে!' ২০১৯ সালের এক বক্তৃতাতেও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন মেলোনি। দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, 'আমি জর্জিয়া। আমি একজন নারী। আমি একজন মা। আমি একজন খ্রিস্টান।'    

সূত্র : দ্য ওয়াল