ফুটবল মাঠে ১২ কিশোর নিহতের পর হিজবুল্লাহর প্রতি ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত গোলান মালভূমিতে লেবানন থেকে আসা রকেট হামলায় ১২ শিশু-কিশোর নিহতের পর মধ্যপ্রাচ্যে আবারও সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।  

৭ অক্টোবরের পর থেকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এটিই সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা বলে দাবি করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এতে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জানিয়েছে, তারা ইসরায়েল ও লেবানন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছে এবং দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় 'সব হামলা বন্ধে' কূটনৈতিক সমাধানের জন্য কাজ করছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা রবিবার রাত পর্যন্ত লেবাননের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। তাদের তীব্রতা ইসরায়েল ও ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর মধ্যে কয়েক মাস ধরে চলা আন্তঃসীমান্ত লড়াইয়ের সমান।

হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারাও হামলা চালিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

গাজায় প্রায় ১০ মাস ধরে চলা যুদ্ধ অবসানে ইসরায়েল ও হামাস যখন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে তখন শনিবারের এ হামলা চালানো হলো।

কী ঘটেছে শনিবার?

শনিবার লেবানন থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং সিরিয়া সীমান্তের পাশে দ্রুজ শহর মাজদাল শামসে একটি ফুটবল মাঠে একটি রকেট হামলা করা হয়। এতে ১২ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।

স্থানীয় বাসিন্দা আনান আবু সালেহ বলেন, ‘আমার মনে হয় ভেতরে ও বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। এখানে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটি অবর্ণনীয়। আমি শিশুদের দেখেছি, আমি কী দেখেছি তা আমি বলতে চাই না, কিন্তু এটি ভয়ংকর, সত্যিই ভয়ংকর। আমাদের আরও নিরাপত্তা দরকার।’

রবিবার হাজার হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্য দিয়ে কফিন নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় নিহতদের ছবির সামনে মোমবাতি জ্বালান বাসিন্দারা।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, রকেটটিকে কেন প্রতিহত করা হয়নি, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। রকেটটির যাত্রার শুরুতেই এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই এটি সম্ভব ছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কালো মাঠের কিছু দূরেই ছিল একটি বোম্ব শেল্টার।

ইসরায়েল, সিরিয়া ও লেবাননে ইসলামের শিয়া সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে উত্থান হয়েছিল দ্রুজ সম্প্রদায়ের। হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউসরি হাজরানের মতে, ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত গোলান মালভূমিতে প্রায় ২৫ হাজার দ্রুজ রয়েছে।

দ্রুজদের ইসরায়েলের সবচেয়ে অনুগত নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে সিরিয়ার কাছ থেকে কৌশলগত মালভূমি গোলান দখল করে নেয় এবং ১৯৮১ সালে এটি সংযুক্ত করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই ওই এলাকাকে দখল করা এলাকা বলে মনে করে। সেখানকার দ্রুজ নেতারা সিরিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো।

মাজদাল শামসের বাসিন্দা হাসান শাকির বলেন, ‘বেশি অনেক বেশি, অনেক বেশি ক্ষুব্ধ। আমার কোনো অনুভূতি নেই যা আমি আপনাদের বোঝাতে পারব।’

বৃহত্তর যুদ্ধের জন্য এর অর্থ কী হতে পারে?

গাজায় সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে যুদ্ধ দোরগোড়ায় ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। তবে শনিবারের হামলায় নিহত ও হতাহতের ঘটনায় ইসরায়েল আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রবিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়াহুড়ো করে দেশে ফিরেছেন। হিজবুল্লাহকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘এই হামলার জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে, যা তারা এখন পর্যন্ত তাদের দিতে হয়নি।’

কীভাবে ও কখন প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা তাকে এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে দিয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, 'সব ইঙ্গিত'ই বুঝিয়ে দেয়, যে রকেটটি হিজবুল্লাহর পাঠানো।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভি বলেছেন, হিজবুল্লাহর অধীনে থাকা ৫৩ কেজি ওজনের ওয়ারহেড সহ ইরানের তৈরি ফালাক রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরদিনই ইসরায়েলে গোলাবর্ষণ শুরু করে হিজবুল্লাহ। এর জবাবে ইসরাইল বিমান হামলা ও ড্রোন দিয়ে হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালায়। বেশিরভাগ হামলা সীমান্তবর্তী এলাকার মধ্যেই করা হয়েছে। যদিও ইসরায়েল লেবাননের আরও উত্তরে হিজবুল্লাহ ও হামাস নেতাদের হত্যা করেছে। সীমান্তের হাজার হাজার মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

অক্টোবরের শুরু থেকে লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রায় ৯০ জন বেসামরিক নাগরিকসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের ২২ সেনা ও ২৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।

হামাসের চেয়ে হিজবুল্লাহর ফায়ারপাওয়ার অনেক বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কাউন্টার-টেররিজমের গবেষক বারাক বেন-জুর সাংবাদিকদের বলেন, গাজায় যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হলে তা সেনাবাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

ইসরায়েল থেকে লেবাননের ভেতরে গুলি চালাতে প্রস্তুত রয়েছে আরও অনেকে। এ পরিস্থিতিতে লেবাননের জাতীয় বিমান সংস্থা সোমবার সকাল পর্যন্ত বৈরুতের সাতটি ফ্লাইট স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে জরুরি ফোনালাপ করেছেন বলে তার কার্যালয় জানিয়েছে।

লেবাননের সীমান্তবর্তী গ্রাম চেবার বাসিন্দা আবদুল্লাহ দালাল বলেন, 'হামলা হবে কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, তবে শত্রুদের পক্ষে কোনো কিছুই অস্বাভাবিক নয়।’

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রকেট হামলাটি খুব কাছেই থেকেই করা হয়েছে।

ইসরায়েল আগেই সতর্ক করে বলেছিল, ইরানে যেকোনো সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে, যা এর আগে কখনোকখনোই হয়নি।

ইরান ও ইসরায়েলের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে আসে এপ্রিলে। একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইসরায়েলে ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে। এর বেশিরভাগই প্রতিহত করা হয়।

সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

গাজার যুদ্ধে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?

যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের কর্মকর্তারা রবিবার রোমে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য বৈঠক করেন। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়া দেশে ফিরেছেন এবং সামনের দিনগুলোতে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে।

মিশরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, গোলান মালভূমিতে হামলার আলোচনা জরুরি হয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, 'উভয় বিষয় পরস্পর সংযুক্ত।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধবিরতি হলে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হবে।'

এক বিবৃতিতে মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'এই অঞ্চলের জনগণকে সংঘাতের আরও বিপর্যয়কর পরিণতি থেকে রেহাই দিতে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে' আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।