বাংলাদেশি পর্যটক না থাকায় মাথায় হাত ভারতীয় ব্যবসায়ীদের
বাংলাদেশি ক্রেতাদের সমাগমে ভারতের কলকাতার মার্কেট ও হোটেলে চলতো জমজমাট ব্যবসা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ভারত ভিসা কার্যক্রম সীমিত করে রাখায় ধস নেমেছে কলকাতার ব্যবসা বাণিজ্যে। এতে বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল কলকাতার স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও চরম দুঃসময় পার করছে।
ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে। তাতে পর্যটন বা বিভিন্ন কাজে যারা ভারতে যাতায়াত করতেন, তারা পড়েছেন বিপাকে।
বাংলাদেশিরা গিয়ে কলকাতার যে এলাকাগুলোতে ওঠেন, সেসব এলাকার হোটেলগুলো ‘খাঁ-খাঁ’ করছে। ক্রেতা সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোভিড মহামারীর সময়ে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আর কঠোর বিধিনিষেধের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।
বাংলাদেশে গেল জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলনের পর থেকেই কলকাতার কিছু কিছু এলাকায় এমন পরিস্থিতি চলছে বলে খবর দিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশে থেকে যারা বিভিন্ন কাজে কলকাতায় যান, তাদের অনেকেই মার্কুইস স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, এসপ্লানেড ও নিউ মার্কেট এলাকার বিভিন্ন হোটেলে ওঠেন। সেখানকার ব্যবসায়ীরা অনেকাংশে বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে মানি এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে, ট্যুর গাইড, ভিসা সহায়তা কেন্দ্র, বাস-ট্রেন-উড়োজাহাজের টিকেট বুকিং এজেন্সি এবং হোটেল, রেস্তোরাঁসহ ছোটখাটো নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেসব এলাকায়।
টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, সেন্ট্রাল কলকাতার দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শতাধিক হোটেল ও ৩ হাজারের বেশি দোকানপাট ব্যাপকভাবে বাংলাদেশি মানুষের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু গত কয়েক মাসে বাংলাদেশিদের ভ্রমণ একেবারে কমে যাওয়ায় সেখানকার ব্যবসা কমে গেছে ৭০ শতাংশ।
কলকাতা হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য মনোতোষ সরকার বলেন, ‘জুলাইয়ের পর থেকে মার্কুইস স্ট্রিটে আমার হোটেলের ৩০টি কক্ষের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটিতে লোকজন থাকছে। ছাত্র আন্দোলন আর শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার আগে হোটেলে একেবারেই ২৬-২৮ জন অতিথি থাকতেন।’
‘ডজনখানেক কক্ষের ছোট অনেক হোটেল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে, কারণ দুয়েকজন গ্রাহক নিয়ে হোটেল চালানো সম্ভব না।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, মনে হচ্ছে আমরা ২০২১ সালে কোভিড-১৯ এর সময় পার করছি, যে সময়টাতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল।’
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়ে ভারতে ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জুলাই থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পর কারফিউ জারি হলে ১৮ জুলাই থেকে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর দৈনিক ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রগুলো বন্ধ অব্যাহত থাকে।
গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সরকার পতনের দুদিন পর এক ঘোষণায় ইন্ডিয়ান ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার (আইভিএসি) জানায়, ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত আইভিএসি বন্ধ থাকবে। পরবর্তী আবেদনের তারিখ এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হবে এবং পরবর্তী কার্যদিবসে পাসপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।’
ভারতের ভিসা না পেয়ে বিড়ম্বনায় জটিল রোগীরা
ঐ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীমিত পরিসরে ভিসা আবেদন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়। এরপর ১৬ অগাস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাণধীর জয়সওয়াল বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কেবল সীমিত পরিসরে জরুরি ও মেডিকেল ভিসা ইস্যু করবে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন।
পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার জন্য সে সময় ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে বিক্ষোভ দেখান ভিসাপ্রত্যাশীরা। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তখন যমুনা ফিউচার পার্ক এবং সাতক্ষীরার ভিসা আবেদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৩ সেপ্টেম্বর শুধু পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার জন্য ১৬টির মধ্যে ১৩টি ভিসা আবেদন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা, রংপুর এবং রাজশাহীর ভিসা আবেদনকেন্দ্র সীমিত পরিসরে কাজ শুরু করে।
২৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক খবরে বলা হয়, ‘বিক্ষোভ ও হাই কমিশনকে হুমকির’ কারণে এ সময়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ২০ হাজার পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছে হাই কমিশন।
এর মধ্যে ২৬ সেপ্টেম্বর এক ঘোষণায় আইভিএসি জানায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও খুলনায় পাঁচটি স্থানে আইভিএসিগুলি জরুরি মেডিকেল এবং স্টুডেন্ট ভিসার জন্য বাংলাদেশি নাগরিকদের সীমিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লট দেওয়া শুরু করেছে।
বাংলাদেশে সব ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র বন্ধ
ঐ ঘোষণায় বলা হয়, ‘পরবর্তী তারিখে আইভ্যাক তার স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু না করা পর্যন্ত এই পরিষেবাগুলো সীমিতই থাকবে।”
লোকজনশূন্য কলকাতার একটি হোটেলে চট্টগ্রামের রেজেন বিশ্বাস নামে একজন টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘গণআন্দোলনের পর থেকে ভারত সরকার নতুন করে ভিসা ইস্যুর ব্যাপারে কঠোর হওয়ার কারণে কলকাতায় বাংলাদেশিদের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আমার আগেই একটি ভিসা ছিল, যে কারণে এখন কলকাতায় আসতে পেরেছি। কিন্তু এখন যারা ভিসার জন্য আবেদন করছে, সেখানে জরুরি চিকিৎসা ছাড়া ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। সম্ভবত বাংলাদেশে অস্থির পরিস্থিতির কারণে ভারত সরকার ভিসার ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছে।’
কলকাতার অন্যান্য অংশের চেয়ে নিউ মার্কেট এলাকার দোকানিরা বেশি বাংলাদেশি ক্রেতা পেয়ে থাকেন। এই দোকানিরাও এখন হতাশ আর বিপর্যস্ত।
তাদের উদ্বেগ, বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা যদি কয়েক বছর চলে এবং ভারত ভিসার ব্যাপারে এরকম কঠোর থাকে, তাহলে ঐ এলাকাগুলোর ক্ষুদ্র অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।
কলকাতার নিউ মার্কেটে চকোলেট, বাদাম ও প্রসাধনী বিক্রি করা ‘চকো নাট’ নামের দোকানটির ক্রেতাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। বাংলাদেশে গণআন্দোলনের আগে, অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ে তাদের দিনে বিক্রির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ লাখ রুপি। অথচ, এখন বিক্রি নেমেছে ৩৫ হাজারে।
‘চকো নাটের’ মালিক মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘মেডিকেল ভিসায় এখন যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ দোকানে আসছেন। কিন্তু যারা নিউ মার্কেট থেকে পণ্য কিনে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেন, তাদের আসা-যাওয়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।’
প্রসাধনী পণ্যের দোকান রয়্যাল স্টোরের মালিক অজয় শ বলেন, ‘এমন খারাপ অবস্থা কেবল তার ১২৪ বছরের পুরনো দোকানের ক্ষেত্রে নয়, গোটা নিউ মার্কেটেই একই অবস্থা।’
‘২০০৮-০৯ সালের দিকে স্থানীয় ক্রেতা কমে যাওয়ার পর এই মার্কেটর চেহারা পাল্টে গেছে। সেসময় নিউ মার্কেট বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্রেতার চাহিদা বিবেচনায় তখন প্রায় সব দোকান তাদের আতিথ্য করতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে সমস্যা শুরু হওয়ার পর এবং ভিসা জটিলতার কারণে ক্রেতা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।’
তার ভাষ্য, ‘আমরা দিনে ২৫ থেকে ৩০ জন কাস্টমার পেতাম, যাদের গড় কেনাকাটার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার। কিন্তু এখন দিনে পাঁচজন বাংলাদেশি ক্রেতাই পাচ্ছি না। আর তাদের কেনাকাটাও কমে ১০ হাজারে চলে এসেছে।’