নতুন করে গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি সিরিয়া, কারণ কী?
গত এক সপ্তাহ ধরে সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে হায়াত তাহিরির আল-শাম (এইচটিএস)। সংগঠনটির সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ইসলামি সংগঠন। এর নেতৃত্ব দিচ্ছে এইচটিএস। গত শুক্রবার সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে নেয় তারা। এর পাশাপাশি সেখানকার বিমানবন্দর ও আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। সিরিয়ার সেনাবাহিনীও আলেপ্পোর বেশিরভাগ অংশে বিদ্রোহীদের প্রবেশের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। এইচটিএসের পরবর্তী লক্ষ্য হামা শহরটি দখলে নেওয়া।
কয়েক বছরের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আসাদকে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। আসাদের পক্ষে তার মিত্র রাশিয়া বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। আকস্মিক বিদ্রোহীদের হাতে আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নতুন মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত বুধবার থেকে এইচটিএস’র নেতৃত্বে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আকস্মিক হামলা শুরু করে। প্রায় এক দশক পর তারা সরকার নিয়ন্ত্রিত ছোট শহরগুলোর দখল নিতে থাকে এবং আলেপ্পোয় পৌঁছে যায়। এরপর আলেপ্পো বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়।
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই গৃহযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। তবে কয়েক বছর আগেই দেশটির বেশিরভাগ অংশে সংঘর্ষ থেমে গিয়েছিল। মিত্র ইরান ও রাশিয়ার সহায়তায় আসাদ বাহিনী সিরিয়ার বেশিরভাগ অংশ এবং সব বড় বড় নগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ২০১৬ সাল থেকে আলেপ্পো সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর দখলে ছিল।
syrea-1সিরিয়ারযুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নানার হাওয়াচ। কীভাবে গৃহযুদ্ধ শেষ করা যায়, তা নিয়েও কাজ করছেন তিনি। নানার জানান, রোববার হামা শহরে বাশার আসাদের সরকার অনেক সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে। এইচটিএস-কে তারা চাপ দিয়ে উত্তরের দিকে খানিকটা সরিয়ে দিতে পেরেছে।
নানারের শঙ্কা, এইচটিএস এতে থামবে না। আগামী কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে আবার গোটা সিরিয়াজুড়ে প্রবল গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন এই গবেষক। তার বক্তব্য, এইচটিএস-এর পেছনে যেহেতু তুরস্কের হাত আছে, তারা যথেষ্ট শক্তি নিয়েই আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে।
এর আগেও গৃহযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ হামা। ২০১১ সালে গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো সিরিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল। প্রাথমিকভাবে তারা খানিকটা অগ্রসরও হতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে হামায় আসাদ সরকার বিপুল সেনা মোতায়েন করে। শুরু হয় প্রবল গৃহযুদ্ধ। আসাদ সরকার বিদ্রোহীদের দমন করতে সমর্থ হয়। সে সময় আসাদ সরকারকে সবরকমভাবে সাহায্য করেছিল ইরান এবং রাশিয়া। তারা এখনো আসাদ সরকারের বন্ধু।
লড়াইয়ের নতুন মুখ
একসময় আল কায়দার অংশ ছিল এইচটিএস। পরবর্তীকালে তারা আলাদা হয়ে যায়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সংগঠনটিকে জঙ্গি সংগঠন বলে আখ্যা দেয়। সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল বিশেষ করে ইডলিব এলাকা এখন এইচটিএস-এর দখলে। প্রায় ৪০ লাখ উদ্বাস্তু সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইডলিবে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এইচটিএস তাদেরও ব্যবহার করার চেষ্টা করছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
তবে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে কেবল এইচটিএস লড়ছে না। তুরস্কের ছত্রছায়ায় থাকা সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এসএনএ-এর একটি অংশও লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দ অধ্যুষিত অঞ্চলে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে।
তুরস্ক বরাবরই আসাদ সরকারের বিরোধী। সিরিয়ার সঙ্গে তাদের বিরাট সীমান্ত। তবে আসাদ সরকারের পাশাপাশি কুর্দ যোদ্ধাদেরও তুরস্ক জঙ্গি সংগঠন বলে মনে করে। এবং দীর্ঘদিন ধরেই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে তুরস্ক।
এদিকে রাশিয়া বরাবরই আসাদ সরকারের বন্ধু। কৌশলগত সুবিধা এই বন্ধুত্বের অন্যতম কারণ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া কিছুটা সমস্যায় থাকলেও সিরিয়ার কৌশলগত অবস্থান তারা ছাড়বে না। বস্তুত, সিরিয়ায় নতুন করে গৃহযুদ্ধের আবহ তৈরি হওয়ার পর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, ‘সিরিয়া বরাবরই আমাদের সহযোগী। এক্ষেত্রেও আসাদ সরকারকে আমরা সবরকম সাহায্য করব। সিরিয়ায় স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।’
syrea-3ইরানের সরকারও আসাদ সরকারের সমর্থক। ‘অ্যাক্সিস অফ রেসিসটেন্স’ এর অংশ আসাদ সরকার। এই গোষ্ঠী মনে করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল তাদের প্রধান শত্রু। এই গোষ্ঠীর অংশ ইরান, লেবাননসহ একাধিক দেশ এবং বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন হুতি।
সিরিয়ার কিছু গোষ্ঠী দাবি করেছে, সোমবার ইরান থেকে প্রায় ২০০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি পিকআপ ট্রাকে করে সিরিয়ায় ঢুকেছে। আলেপ্পোর কাছে সিরিয়ার সেনাকে সহায়তা করবে তারা। সব মিলিয়ে নতুন এক গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি সিরিয়া। বস্তুত ২০১১ সাল থেকে টানা গৃহযুদ্ধের কারণে কার্যত ধসে গেছে দেশের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা। তার ওপর আবার নতুন করে এই লড়াই আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেবে দেশটিকে।