৪০ বছর পর কুর্দিদের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কিসের ইঙ্গিত

তুরস্কের সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ চার দশক ধরে চলা সংঘাত অবসানে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)।

স্থানীয় সময় শনিবার (১ মার্চ) পিকেকে সমর্থিত গণমাধ্যম ফিরাত নিউজ এসেন্সির কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় কুর্দিরা।

এর আগে, বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) কারাবন্দি কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান কুর্দিপন্থি ডিইএম পার্টির একটি প্রতিনিধিদল। সে সময় পিকেকেকে অস্ত্র সমর্পনের আহ্বান জানান তিনি।

দশকের পর দশক ধরে চলা সংঘাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে উল্লেখ করে বিদ্রোহী দলটিকে চিরতরে বিলুপ্ত করারও আহ্বান জানান সংগঠনটির প্রধান।

তুরস্ক সরকারের সঙ্গে চলা বিদ্রোহের কারণে ১৯৯৯ সাল থেকে কারাগারে রয়েছেন ওজালান। ওই সাক্ষাতের পরই নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে দলটি।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শান্তি ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে পিকেকে নেতা ওজালানের আহ্বান বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন করে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের (পিকেকে) পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে না।

ওজালানের এই ঐতিহাসিক ঘোষণা তুরস্ক সরকার ও পিকেকের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নতুন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

গত অক্টোবরে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের জোটের অংশীদার দেভলেত বাহচেলি এই শান্তি আলোচনা শুরু করেন। সে সময় ওজালানের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীটি সহিংসতা পরিত্যাগ করে বিলুপ্ত হলে তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এই ডানপন্থী রাজনীতিক।

এরদোয়ানের গদি বাঁচাতেই কি এই উদ্যোগ?

তুরস্কের রাজনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে এই শান্তি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এলো। মূলত তুরস্কের মসনদে টিকে থাকতে ডিইএম পার্টির সমর্থনের বিকল্প নেই এরদোয়ানের। কারণ দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি পাবেন না এরদোয়ান।

নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে কিংবা সংবিধান অনুসারে আগাম নির্বাচন আয়োজনে সংসদে ডিইএম পার্টির সমর্থন প্রয়োজন হতে পারে, আর এতে করে নিজের গদি বাঁচাতে পারেন এরদোয়ান।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কে গণতন্ত্র, কুর্দি জনগণের অধিকার ও কারাবন্দি ওজালানের জেলের পরিবেশ উন্নত করার দাবি জানিয়ে আসছে ডিইএম পার্টি। এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওজালানের সাম্প্রতিক ঘোষণা শান্তি আলোচনাকে গতিশীল করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে এ বিষয়ে তুরস্ক সরকার এখনও সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি।

তুরস্কে সরকারি পক্ষ ও কুর্দিদের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস অনেক পুরনো। দেশটির জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জাতিগতভাবে কুর্দি। তবে কয়েক প্রজন্ম ধরে দেশটির সরকার কুর্দিদের বিষয়ে কঠোর নীতি অনুসরণ করে আসছে। এ কারণেই নিজেদের অধিকার আদায়ে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করে আসছে কুর্দিরা।

কে এই ওজালান

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র আবদুল্লাহ ওজালান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বামপন্থি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে তিনি পিকেকে গঠন করেন, যাদের প্রধান দাবি ছিল তুরস্কের ভেতরে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠন। ছয় বছর পর দেশের সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে সংগঠনটি।

সশস্ত্র কার্যকলাপ পরিচালনা করার কারণে সরকারের কোপের মুখে ১৯৭৯ সালে সিরিয়াতে পালিয়ে যান ওজালান। সেখানেই ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন তিনি। কিন্তু তুরস্কের চাপের মুখে তাকে নির্বাসিত করতে বাধ্য হয় সিরিয়া।

পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে কেনিয়া থেকে তাকে আটক করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারই তার ঠিকানা।

পিকেকের কার্যক্রম

ওজালানের পিকেকে ১৯৮৪ সাল থেকে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে একটি স্বাধীন কুর্দিরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বিদ্রোহ শুরু করে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন চালায় তারা। সে সময়ও সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখে গোষ্ঠীটি।

গোষ্ঠীটিকে তুরস্ক ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।