তুরস্কে ধরপাকড় উপেক্ষা করে এরদোগানবিরোধী বিক্ষোভ চলছে
তুরস্কের সরকারবিরোধীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর ধরপাকড় ক্রমাগত বাড়ছে। গেল ১৯ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ১৩৩ জনকে আটক করা হয়েছে। যাদের মধ্যে সাতজন সাংবাদিকও রয়েছেন।
ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুকে গেল বুধবার (১৯ মার্চ) আটকের পর থেকে তুরস্কে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। যা দেশটিতে গেল এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। এতে সেখানকার গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও নিউ ইয়র্ক টাইমস এমন খবর দিয়েছে।
আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে ইস্তানবুলের মেয়রকে। কাজেই জনপ্রিয় একজন প্রার্থীকে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরিয়ে দিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এমন একটি সময়ে এই ধরপাকড় শুরু হয়েছে, যখন একটি ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কেন্দ্রে রয়েছে তুরস্ক। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ‘এতে নিজের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিশানা বানানোর মতো মুক্ত পরিবেশ পেয়েছেন এরদোগান।’
মেয়রের গ্রেপ্তারের ঘটনায় গুটিকয়েক ইউরোপীয় নেতা সমালোচনা করলেও বেশিরভাগই নিশ্চুপ রয়েছেন। শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না।
ফক্স নিউজের সাবেক সঞ্চালক টুকার কার্লসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইস্তানবুলের মেয়রের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিফ উইটকফ। তিনি বলেন, সম্প্রতি এরদোগানের সঙ্গে কথা বলেছেন ট্রাম্প। তখন এই ফোনাপের কথা প্রকাশ করেনি হোয়াইট হাউস।
বিস্তারিত তথ্য নিয়ে উইটকফ বলেন, ‘তাদের এই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তুরস্ক থেকে ভালো ও ইতিবাচক কিছু খবর আসছে।’
রবিবার (২৪ মার্চ) আনুষ্ঠানিকভাবে একরেম ইমামোগলুকে আটকের নির্দেশ দেন আদালত। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তা ও দুর্নীতির অভিযোগের বিচার চলছে, এছাড়াও ঘুষ, জালিয়াতি ও অবৈধভাবে ব্যক্তিগত উপাত্ত রেকর্ড করার অভিযোগও রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হবে কিনা; এখন পর্যন্ত আদালদের পক্ষ থেকে এমন কোনো আদেশ আসেনি। তাকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
গেল দুই দশকের বেশি সময় ধরে তুরস্কের রাজনীতিতে একক আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছেন এরদোগান। সমালোচকদের অভিযোগ, প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করে দিতে তিনি রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করছেন। নির্বাচনী দৌড় থেকে একজন প্রার্থীকে সরিয়ে দিতে তাকে গ্রেপ্তার করার ঘটনা কর্তৃত্ববাদের এক নতুন অধ্যায়েরও সূচনা করেছে।
সাংবাদিকদের সংগঠন ডিস্ক-বেসিন-ইজ ইউনিয়ন জানিয়েছে, ‘অন্তত আট প্রতিবেদক ও ফটো সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানুষের সত্য জানার অধিকারের ওপর বড় ধরনের আঘাত।’
সামাজিকমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ইউনিয়ন লিখেছে, ‘সাংবাদিকদের নীরব করিয়ে দিয়ে কেউ সত্য গোপন করতে পারবে না।’
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলী ইরলিকায়া বলেন, বিক্ষোভে ১২৩ পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে এসিড, ছুরি ও অগ্নিবোমা জব্দ করা হয়েছে। জমায়েত ও বিক্ষোভ করার অধিকারের অপব্যবহার করছে কিছু চক্র। এরমধ্য দিয়ে তারা জনশৃঙ্খলা বিঘ্ন, রাস্তার অস্থিরতা ও পুলিশের ওপর হামলা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
‘আটকদের মধ্যে কিছু মানুষের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। বাকিদেরও অপরাধের অতীত ইতিহাস রয়েছে।’
জনগণ যাতে এসব উসকানিতে পা না দেন, সেই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের খবরে বলা হয়েছে, ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে একরেম ইমামোগলুকে সরিয়ে দিতে এই ধরপাকড় করা হচ্ছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
তাদের দাবি, তুরস্কের আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সেখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই।
ইস্তানবুলের পশ্চিমাঞ্চলের সিলিভরি কারাগারে নেওয়া হয়েছে একরেম ইমামোগলুকে। দেশটির বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) প্রাথমিক নির্বাচনে তাকে প্রেসিডেন্টপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। দলটিতে সতেরো লাখ ভোটার রয়েছে।
সিএইচপি জানিয়েছে, এছাড়াও দলীয় সদস্য নন, এমন লোকজনও ‘সংহতি ব্যালটের’ মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন।
৪৭ বছর বয়সী ইমামোগলু ছাড়াও আরও অনেককে বিচারপূর্ব আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তার একজন মুখপাত্র ও দুজন জেলা মেয়র রয়েছেন।
২০১৯ সালে তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হন ইমামোগলু। এরপর তিনটি নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। যা এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (একে) পার্টির জন্য বড় আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এরআগে ২৫ বছর ধরে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন একে পার্টি থেকে।
এরআগে অনিয়মের অভিযোগ এনে এক কোটি ৬০ লাখ নাগরিকের শহরটির পৌর নির্বাচনের ফল বাতিলে চাপ প্রয়োগ করেছিল তুরস্কের ক্ষমতাসীন এই দলটি। কিন্তু কয়েক মাস পরে আবারও নির্বাচন হলে তাতে ইমামোগলুই জয়ী হন।