কেনিয়ায় পাচার থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পিঁপড়াও, উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা
পৃথিবীজুড়ে অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন অপরাধচক্র মানুষ থেকে শুরু করে নানা পণ্য ও প্রাণী পাচার করে থাকে। এসব দুষ্ট লোকের হাত থেকে শেষমেষ রক্ষা পায়নি পিঁপড়াও! ক্ষুদ্র এই জীবগুলোকেও টিউববন্দি করে অর্থ উপাজর্নের আশায় পাচার করা শুরু করেছে মানুষ। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
এই পিঁপড়া পাচারের ঘটনাটি ঘটেছে আফ্রিকান দেশ কেনিয়াতে। দেশটির বনাঞ্চলগুলো বিভিন্ন বণ্যপ্রাণীর পাচারের জন্য আগে থেকেই কুখ্যাত। চলতি মাসের শুরুর দিকে নিজেদের প্রতিদিনের দায়িত্ব পালন করছিলেন কেনিয়ার বণ্যপ্রাণী সেবার (কেডব্লিউএস) কর্মকর্তারা। এ সময়ে ৫ হাজার পিঁপড়া পাচার করার সময় দুই বেলজিয়ান তরুণকে আটক করেছেন তারা।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, এ অভিযানটি ছিল সবথেকে ছোট প্রাণীর পাচার রোধ করার সবথেকে বড় অভিযান। কারণ উদ্ধারকৃত প্রাণীগুলো ছিল ১৮ থেকে ২৫ মিলিমিটার দীর্ঘ পিঁপড়া।
এই পিঁপড়াগুলোকে এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে পাচার করার জন্য ওই দুই তরুণ একটি কাভার্ড ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে জানান কেডব্লিউএসের কর্মকর্তারা। সিরিঞ্জ ও টিউবের মধ্যে তুলা ভরে তার মধ্যে পিঁপড়াগুলোকে রাখা হয়েছিল। এই পরিবেশে পিঁপড়া বেশ কয়েকদিন বেঁচে থাকতে বলে জানান কর্মকর্তারা।
পাচারকারী তরুণ লর্নি ডেভিড বলেন, ‘আমরা কোনো আইন ভাঙতে এ কাজ করিনি। দুর্ঘটনাবশত বোকামির কারণে এটি করে ফেলেছি।’
ডেভিড ও তার সহযোগী সেপে লোডেউইজিক্স দুজনেই ১৯ বছর বয়সী। পিঁপড়া পাচারের অভিযোগে তাদের আটক করা হয়েছে। এর আগে একই অভিযোগে ৪০০ পিঁপড়াসহ আরও দুই ব্যক্তিতে আটক করেন কেনিয়ার বন কর্মকর্তারা। গত ২৩ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পর্যালোচনা করে আদালত তাদের হেফাজতে রাখারই নির্দেশ দিয়েছেন।
কেডব্লিউএসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পিঁপড়া পাচারের এই ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণী পাচারের ক্ষেত্রে এক ধরনের পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে। বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে এখন কম দৃশ্যমান ছোট সাইজের প্রাণীর পাচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
একই সঙ্গে এই পাচারের ঘটনা কয়েক দশক ধরে মানুষের এক বিচিত্র শখের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন কেনিয়ার বন কর্মকর্তারা। পিঁপড়া পালন ও সংগ্রহ করার শখ বাড়তে দেখা গেছে মানুষের মধ্যে।
কেডব্লিউএসের বিবৃতিতে জানা যায়, উদ্ধারকৃত পিঁপড়াগুলোর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার মেসর সেপ্যালোটস জাতের বড় লাল পিঁপড়া। এটি ফসল সংগ্রহের জন্য পরিচিত। এ জাতের রাণী পিঁপড়াগুলো ২০ থেকে ২৪ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
অ্যান্ট আর ইউএস নামে পিঁপড়া বেচাকেনার একটি ওয়েব সাইট থেকে জানা যায়, এই পিঁপড়াগুলোর আচরণের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাছাড়া এরা নিজেদের কলোনি (পিঁপড়াদের নির্মিত বাসস্থান) তৈরিতে খুবই দক্ষ। এ কারণে এটি অনেকেরই ‘স্বপ্নের প্রজাতির পিঁপড়া’। এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য বিদেশে এই পিঁপড়াগুলোর চাহিদা বেড়েছে বলে মনে করে কেডব্লিউএস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পিঁপড়া বিক্রেতা জানান, পিঁপড়ার বাজার ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছে। প্রতিবছরই বিক্রি বাড়ছে, পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই দুনিয়ায় একটু প্রকৃতির পরশ পেতে অনেকেই পিঁপড়া পালতে পছন্দ করেন।
তবে এ ধরনের কার্যকলাপের কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, পিঁপড়াগুলোকে যদি তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলের বাইরে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পালন করা হয়, তাহলে তারা আক্রমণাত্বক হয়ে উঠতে পারে। পরিবেশ ও অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রেই এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
পিঁপড়াদের স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে সরিয়ে ফেলা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে মনে করে কেডব্লিউএস।
কেনিয়ার জীববিজ্ঞানী ডিনো মার্টিন জানান, আফ্রিকার সাভান্না অঞ্চলের হারভেস্টার পিঁপড়াগলো (ফসল সংগ্রহকারী পিঁপড়া)) সবথেকে বেশি পাচার হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমের (বাস্তুসংস্থান) ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, হারভেস্টার পিঁপড়াগলো নিজেদের খাদ্য হিসেবে ফসলের বীজ সংগ্রহ করে থাকে। তাদের একেকটি কলোনি থেকে কয়েক কেজি ফসলের বীজ পাওয়া যায়। বীজগুলো নিজেদের কলোনিতে নিয়ে আসার সময় কিছু আবার জমিতে পড়েও যায়। এগুলো আবার অন্যান্য প্রাণীরাও খায়।
মার্টিন বলেন, ‘আমার কাছে অবাক লাগে পাচারকারীরা এখন কেনিয়ার পিঁপড়াগুলোর ওপরও নজর দিয়েছে!’
এ ধরনের কীটপতঙ্গকে বাজারজাত করতে চাইলে সেটি পরিকল্পিতভাবে করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এতে করে স্থানীয় বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে বলে মনে করেন তিনি। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এসব কীটপতঙ্গ উৎপাদন করে তা বিক্রি করা যায়, এক্ষেত্রে তিনি কেনিয়ার কেপেপো প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
আফ্রিকার বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার সহ-সভাপতি ফিলিপ মুরোথি জানান, পিপঁড়া প্রকৃতির জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি জীব। এটি মাটিকে সমৃদ্ধ করে, ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে, অন্যান্য প্রাণীকে খাবার সরবরাহ করে।
তিনি বলেন, ‘একটা সুন্দর বন দেখতে তো সবারই ভালো লাগে। তবে কিভাবে এই বনটি গড়ে উঠল তা অনেকেই ভেবে দেখেন না। এর পেছনে পিঁপড়া কিংবা ব্যাকটেরিয়ার মতো ছোট জীব থেকে শুরু করে বিশালাকার প্রাণী সবার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কই জরুরি।’