গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৯৪ ফিলিস্তিনি নিহত
গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলি ও বিমান হামলায় অন্তত ৯৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন জরুরি মানবিক সহায়তা পাওয়ার আশায় অপেক্ষমাণ ছিলেন।
নিহতের এই সংখ্যা বুধবার রাত ও বৃহস্পতিবার মিলিয়ে গণনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
রাতের বেলা দক্ষিণ গাজায় একটি তাঁবু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুতদের ওপর হামলা চালানো হলে বহু পরিবারের সদস্য নিহত হয়। এতে একটি পরিবারেরই ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর জানা গেছে, যাদের মধ্যে ১২ বছরের কম বয়সী ছয় শিশুও ছিল।
ওই ঘটনার পর সরেজমিনে নিহত সন্তান ও নাতি-নাতনিদের লাশের পাশে বসে বিলাপ করতে দেখা যায় ইন্তেসার আবু আসসি নামের এক নারীকে। বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, ‘আমার সন্তান, আমার সন্তান... আমার প্রিয়জন।’
খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালের মর্গের মেঝেতে চাদরে মোড়ানো এক শিশুকন্যার কপালে চুমু খেতে দেখা যায় আরেক নারীকে।
গাজা মধ্যাঞ্চলে আল-আকসা শহিদ হাসপাতালের মর্গে ছয় বছর বয়সী বোনের লাশের পাশে বসে ছিল তার ছোট ভাই। স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় একটি খাবারের দোকানের পাশে হামলায় তার পরিবারের আরও একজনসহ মোট আটজন নিহত হন।
অন্যদিকে, গাজা সিটিতে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দেওয়া একটি স্কুলে চালানো আরেকটি হামলায় অন্তত ১৫ জন নিহত হন।
এই সব হামলার পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই সহায়তা নিতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে আরও বহু ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছেন।
গাজা মানবাধিকার সংস্থা (জিএইচএফ) পরিচালিত খাদ্য বিতরণকেন্দ্রে যাওয়ার সময় পথে গুলিতে পাঁচজন নিহত হন।
বার্তা অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) সাংবাদিকদের তথ্য অনুসারে, এই সংস্থাটি (জিএইচএফ) একটি নতুন ও গোপনীয় মার্কিন সংস্থা, যারা ইসরায়েলের সমর্থনে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য সরবরাহ করছে।
এ ছাড়াও জাতিসংঘের ত্রাণ বহনকারী ট্রাকের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় গাজাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে আরও ৪০ জন নিহত হন বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্মকর্তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে এপি জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা প্রায়ই ত্রাণ নিতে জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সেনা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জাতিসংঘের ট্রাক আসার অপেক্ষায় থাকা লোকদের দিকেও গুলি চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত মে মাসে বিতরণকেন্দ্র খোলার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হয়েছেন।
বিতরণকেন্দ্রগুলোর দিকে যাওয়ার পথে মোতায়েন থাকা ইসরায়েলি সেনাদের দাবি, তারা কেবল ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য সতর্কতামূলক গুলি ছোড়ে অথবা যারা তাদের খুব কাছাকাছি আসে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এসব কেন্দ্রের নিরাপত্তায় সশস্ত্র মার্কিন ঠিকাদাররাও নিয়োজিত রয়েছে জানিয়েছে তারা।
ক্ষুধাকে ‘যুদ্ধের অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল!
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, গাজার সাধারণ নাগরিকদের অনাহারে রাখাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল, যা চলমান গণহত্যারই অংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জিএইচএফের বিতরণব্যবস্থা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা মাত্র। কারণ নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ওই ত্রাণ বিতরণব্যবস্থা ছাড়া জাতিসংঘের পাঠানো ত্রাণ খুবই সীমিত পরিমাণে গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে ইসরায়েল।
বিবৃতি অনুসারে, ‘প্রাণঘাতী, অমানবিক ও ব্যর্থ একটি সামরিক সহায়তা কাঠামো বজায় রেখে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ খাদ্যান্বেষণে থাকা নিঃস্ব ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু-ফাঁদে ফেলছে।’
অবশ্য অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই সংস্থাটি হামাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের সব ধরনের অপপ্রচার অনুসরণ করছে।
ইসরায়েল চায়, জাতিসংঘের বিদ্যমান মানবিক সহায়তা নেটওয়ার্কের পরিবর্তে জিএইচএফ-ই হোক ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রধান ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা।
তাদের দাবি, জাতিসংঘের সহায়তার বড় অংশ হামাস ছিনিয়ে নেয়, যদিও ইসরায়েলের এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন সহায়তা সংস্থা।
জিএইচএফ-কে প্রত্যাখ্যান করে সংস্থাগুলো বলছে, এই সংস্থাটি ফিলিস্তিনিদের প্রয়োজনীয় সহায়তা সরবরাহে ব্যর্থ। এটি ফিলিস্তিনিদের বিপন্ন করে ইসরায়েলের লক্ষ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার মাত্র।
চলতি বছর ইসরায়েল আড়াই মাসের বেশি সময় গাজায় খাদ্যসহ সব ধরনের ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল। আগে থেকেই ভুগতে থাকা গাজাবাসীকে আরও বেশি অনাহারের দিকে ঠেলে দিয়েছে এই কর্মকাণ্ড। ইসরায়েলের দাবি, এতে হামাসকে চাপ দিয়ে বন্দিমুক্তির আলোচনায় ছাড় দিতে বাধ্য করা সহজ হবে।
মার্চে অবরোধ কিছুটা শিথিল করে ইসরায়েল। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গাজায় ত্রাণ সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিরক্ষা সংস্থা সিওজিএটি বুধবার জানায়, ১৯ মে থেকে এখন পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে।
এই হিসাব অনুযায়ী, দিনে গড়ে মাত্র ২৮টি ট্রাক সেখানে পাঠানো হয়েছে, যেখানে সহায়তাকর্মীরা দিনে কয়েকশ’ ট্রাক প্রয়োজন বলে দাবি করে আসছেন।
তবে নিজেদের কার্যক্রমের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে জিএইচএফ বলেছে, তারা ৫ কোটি ২০ লাখের বেশি খাবারের সমতুল্য সহায়তা দিয়েছে। প্রতিটি খাবারের প্যাকেটে ডাল, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থাকে, যা একজনের ৫০ বেলার খাবারের সমান।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসব কেন্দ্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। লোকজন হুড়োহুড়ি করে খাবারের বক্স ছিনিয়ে নেয়। কেউ একাধিক নেয়, আবার অনেককেই ফিরতে হয় খালি হাতে। পরে এসব বক্স বাজারেও মেলে। সেখানে থেকে কিনতে গেলে হাঁকা হয় আকাশছোঁয়া দাম।