হিরোশিমায় হামলার ৮০ বছর, বিশ্বনেতাদের ভূমিকায় উদ্বিগ্ন হিবাকুশারা

আজ ৬ আগস্ট, এই দিনটি বিশ্ববাসীকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াহতা মনে স্মরণ করিয়ে দেয়। জাপানের হিরোশিমাতে পারমাণবিক বোমা ফেলার ৮০তম বার্ষিকী আজ।

ভয়াবহ ওই হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা স্থানীয়ভাবে হিবাকুশা নামে পরিচিত। ভয়াবহ স্মৃতিবিজড়িত এই বিশেষ দিনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে বিশ্বনেতাদের সমর্থনে হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

হিরোশিমা হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। বেশিরভাগ হিবাকুশাই অশীতিপর হয়ে পড়েছেন।

৯৪ বছর বয়সী মিনোরু সুজুতো নামে এক হিবাকুশা বলেন, ‘আর ১০ বা ২০ বছর পর এই দুঃখ ও যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা জানানোর মতো কেউ বেঁচে থাকবে না। তাই যতটা পারি, আমি আমার গল্পটা সবাইকে বলতে চাই।’

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। ওই হামলা শহরটিকে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়। তিন দিন পর নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমা হামলায় আরও ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়।

এ দিনটি উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় এ বছর ১২০টি দেশ ও অঞ্চলের প্রতিনিধিসহ অন্তত ৫৫ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। ১৯৪৫ সালের মার্কিন বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ‘লিটল বয়’ নামক বোমাটি ফেলা হয়েছিল। সেকারণে এই দিনের ওই সময়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং শান্তির ঘণ্টা বাজানো হয়।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা, হিরোশিমা শহরের মেয়র ও অন্যান্য কর্মকর্তারা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। মেয়রের ভাষণের পর শান্তির প্রতীক হিসেবে ডজনখানেক সাদা কবুতর অবমুক্ত করা হয়।

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে জাপানের উদ্বেগ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রতি বিশ্বজুড়ে যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাতসুই।

তিনি বলেন, ইতিহাসের এসব মর্মান্তিক ঘটনা থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শিক্ষা নেওয়ার কথা থাকলেও, তাদের এই প্রবণতা সেই শিক্ষাকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করছে। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বহু মানুষের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা শান্তি প্রতিষ্ঠার কাঠামোগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি।

পারমাণবিক বোমা হামলা–বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে জাপানের তৃণমূল সংগঠন নিহান হিদানকিয়ো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক হুমকির মুখোমুখি হওয়ার বেশি দূরে নেই আমরা।

এক বিৃবতিতে সংগঠনটি আরও বলেছে, বর্তামানে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলোর মনোভাব সামান্য হলেও পরিবর্তন করা।

৭৪ বছর বয়সী কাজুও মিয়োশি নামে এক জাপানি নাগরিক বলেন, ‘এই ভুলের যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই কামনা করি। আমরা পরমাণু অস্ত্র চাই না।’

এদিকে জাতিষংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বেঁচে যাওয়া মানুষের সাক্ষ্য ও শান্তির বার্তা বহন করে চলাটাই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতকে স্মরণ করা মানে আজকের ও আগামীর শান্তিকে রক্ষা ও নির্মাণ করা।’

সম্প্রতি ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলার সঙ্গে তুলনা করে তা ‘ন্যায়সঙ্গত’ বলে দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে অনেক হিবাকুশা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

মাতৃগর্ভেই বিকিরণের শিকার হওয়া ৭৯ বছর বয়সী সাবেক শিক্ষক কোসেই মিতো বলেন, ‘ এটা হাস্যকর! যতদিন পর্যন্ত হামলাকারীর পক্ষ থেকে একে ন্যায়সঙ্গত বলা হবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা কখনো পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল করতে পারব না।’

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে জাপানের অবস্থান

হিরোশিমার এবারের বর্ষপূর্তি এমন একটি সময়ে পড়েছে যখন নিজ দেশের নিরাপত্তার নামে আন্তর্জাতিক মহলে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। এমনকি খোদ জাপানেও এই প্রবণতা দেখা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ছাতার নিচে থাকার কারণে এখনও পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিকে সই করেনি জাপান। জাপান সরকারকে এই চুক্তিতে সই ও অনুমোদনের আহ্বান জানান হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাতসুই। তবে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করলেও চুক্তির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি প্রধানমন্ত্রী ইশিবা। বরং তিনি পরমাণবিক অস্ত্র রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘জাপান নিজে পরমাণু অস্ত্র না রাখলেও, পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশী দেশ দ্বারা ঘেরা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক প্রতিরক্ষা নির্ভরতা জাপানের নীতির পরিপন্থি নয়।’

এর আগে জাপানের বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রী দেশটির পারমাণবিক হামলার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । তবে অনেক হিবাকুশার মতে, এগুলো এখন কেবল ‘ফাঁকা বুলি’ ছাড়া কিছুই নয়।

অনেকদিন ধরেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই হামলায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর দায় স্বীকারের দাবি জানিয়ে আসছেন।